প্রতি বছর আগস্ট আসে এক নিদারুণ কষ্টের বার্তা নিয়ে। ফি-বছর বাঙালি শোককে শক্তিতে রূপান্তরের শপথ গ্রহণ করে। কত আলোচনা, হয় কত বিলাপ! ক্ষমতার রং বদলের ওপর শ্রদ্ধাঞ্জলি আয়োজনের আকৃতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। বাঙালির দীর্ঘ বহমান ক্রোধ, লজ্জা আর কলঙ্কের অবসান ঘটাতে এ হত্যাকাণ্ডের একটি বিচার হয়েছে বটে। কিন্তু হৃদয়ের গহিনে অহর্নিশ প্রবহমান কষ্টের জ্বালা আজও রয়ে গেছে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর অপরাধ সংঘটনে মাঠপর্যায়ের কুশীলবদের বিচার সম্পন্ন হলেও এ হত্যাকাণ্ডের অন্তরালের শক্তি আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি-দর্শনের কাউন্টার থিসিসের উদ্গাতা অপশক্তি আজও স্বমহিমায় বিরাজমান। নতুন জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, পাকিস্তানি ধারার সামরিক শাসন প্রবর্তন, আইয়ুবীয় পদ্ধতির নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দখলদারিত্বের বৈধতা দানের প্রচেষ্টা ইত্যাদি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। কিছু ‘বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা’ কর্তৃক আগস্ট হত্যাকাণ্ড ছিল জনমনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সুপরিকল্পিত পন্থা। হাইকমান্ডের কারও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া সুরক্ষিত এলাকা থেকে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রসহ নির্বিঘ্নে বের হয়ে আসতে পারার রহস্যটা উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন। এ কাজ মুক্তিযুদ্ধের মাটিতে সৃষ্ট বাংলাদেশের কলঙ্ক মোচনে সহায়ক হবে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী কিছু সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অগণতান্ত্রিক পথও বন্ধ হবে। আর তাই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই করা উচিত।
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের উদ্যোক্তা ও তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে পাকিস্তান শাসনামলে ক্যু-পরবর্তী সামরিক শাসকদের কর্মকাণ্ড ও বক্তৃতা-বিবৃতির সঙ্গে ১৫ আগস্ট-পরবর্তী দৃশ্যপট মিলিয়ে নিলে পরিস্কার চিত্র পাওয়া যাবে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ‘শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের’ মাধ্যমে প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা জনগণকে ‘অশিক্ষিত’ আর রাজনীতিবিদদের ‘নির্বোধ’ আখ্যা দিয়ে ‘গুরুতর ভুলগুলো’ শোধরানোর জন্য সামরিক শাসনের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। এরপর জেনারেল আইয়ুব খান বিশ্বাসঘাতকতার ‘পুরস্কারস্বরূপ’ তিন সপ্তাহের মাথায় ইস্কান্দার মির্জাকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিতাড়ন করেন। পরবর্তীকালে আইয়ুব খান রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করেন তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘আইয়ুবীয় পদ্ধতি’র নির্বাচন আখ্যা দিয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে। এ সময়ে কংগ্রেসসহ প্রগতিশীল সংগঠনের প্রবীণ রাজনীতিকদের চোরাচালানসহ বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৬২ সালে রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও কংগ্রেসসহ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইয়াহিয়া খানের শাসনামলেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অন্তরালের শক্তিগুলো পুরস্কারস্বরূপ আওয়ামী লীগের ঘরের শত্রু খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্টের পদে বসালেও ইস্কান্দার মির্জার মতো তাকেও ‘কিক আউট’ করতে বেশি সময় নেয়নি। জেনারেল জিয়াও আইয়ুব খানের মতো ‘নির্বোধ’ রাজনীতিবিদদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেন, আর নিষিদ্ধ ঘোষিত যুদ্ধাপরাধী দল আর ‘৭১-এর পর গা-ঢাকা দেওয়া অভিযুক্ত দালালদের জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত করে দিয়ে তথাকথিত ‘বহুদলীয়’ গণতন্ত্র চালু করেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা খুব সহজেই রাজনৈতিকভাবে পুনর্জীবন লাভ করে।
১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বর্ণনা করে চরম শাস্তির হুমকি দিয়ে গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, বেআইনিভাবে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের পদ শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনকে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের কুশীলবরা বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। হত্যাকারীদের মধ্যে পাকিস্তানি নৃশংসতা আর বর্বরতার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। হত্যাকারীদের বর্বরতার চিত্র দেখে ধারণা করা যায়, তারা বঙ্গবন্ধুর ওপর টলারেন্স লেভেলের সর্বোচ্চ মাত্রায় ক্ষুব্ধ ছিল। মূল টার্গেটের বাইরেও যে ধরনের তাণ্ডবলীলা চলেছে তা ইতিহাসে বিরল। তবে কি ‘পাকিস্তান ভাঙার’ অপরাধে ইয়াহিয়ার তথাকথিত সামরিক ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিলম্বিত বাস্তবায়ন? দুঃখের বিষয়, বর্বর পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি তা বাঙালি নামধারী মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী কিছু পাকিস্তানি প্রেতাত্মা কত সহজেই করে ফেলল। এ হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী দৃশ্যপট বলে দেয় এটি শুধু ‘রেজিম’ পরিবর্তনের জন্য নয়, এটি ছিল একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য। পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়তো সম্ভব হয়নি কিন্তু পাকিস্তানি ধারার রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল। বেছে বেছে দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা আর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে? পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস পাল্টে দেওয়ারই-বা কারণ কী?
গোয়েবলসীয় থিওরি অনুযায়ী একটি মিথ্যাকে বারবার প্রচারণার ফলে মিথ্যাটি মানুষের কাছে সত্য হিসেবে মনে হতে শুরু করে। তেমনি আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ অপপ্রচার আর ইতিহাস বিকৃতির ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া একটি প্রজন্মের মনে আওয়ামী লীগ একটি নিন্দিত সংগঠন এবং বঙ্গবন্ধু একজন অপাঙ্ক্তেয় মানুষ হিসেবে চিত্রিত হতে শুরু করেছিল। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার শেখ কামাল, শেখ মনিসহ অনেকের বিরুদ্ধে চলে ‘হেট ক্যাম্পেইন’। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, মানুষের সহজাত সহানুভূতি পাওয়ার পথও রুদ্ধ করার চেষ্টা চলে অব্যাহতভাবে। মহাকালের অনিবার্য সত্যের ধারানুযায়ী ইতিহাসের পথদ্রষ্টা হিসেবে বেঁচে রইলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। দুই বোনের অসীম সাহস, বুকে পাথরচাপা ধৈর্য আর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আন্তরিক প্রয়াসের ফলে জাতি নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়। ইতিহাস ফিরে পায় তার সঠিক স্থান। এটি সম্ভব না হলে এ দেশে আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস পড়তে হতো পাকিস্তানের সিলেবাস থেকে, যা সেখানে পড়ানো হয়।
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় পুরোপুরি কার্যকর না হওয়াটা এখনও হুমকি মনে করি। অন্ধকারে ওঁৎ পেতে রয়েছে হিংস্র হত্যাকারীর দল। শেখ হাসিনার ওপর বারবার আঘাত একই সূত্রে গাঁথা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা পঁচাত্তরের অসম্পূর্ণ মিশন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর রক্তধারা প্রগতির পথ চিরকালের জন্য বন্ধ করতে চেয়েছিল। আর ২০০৪ সালে চেয়েছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে। তারা মুজিবীয় দর্শন, মুক্তিযুদ্ধে উৎসারিত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয় চেতনা ভুলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি ধারার ধর্মীয় চেতনার আলোকে বিভাজিত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার সম্পন্ন হলেও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। দণ্ডিত অপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা ছাড়া আইনের শাসনের ভিত্তিতে সভ্য সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে না। বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশে পরাজিত শক্তি ও তার কয়েক প্রজন্মের বংশধরদের রাজনীতি করার অধিকার রহিত হওয়া দরকার। দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত সুবিধাভোগী ও সমর্থকদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ১৫ আগস্ট হত্যার পর যারা ভেবেছিল ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধু চ্যাপ্টার ‘ক্লোজড’, তারা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে নিজের অজান্তেই হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে নানা আলামত রেখে গেছে। তাদের কর্মকাণ্ড ‘ডকুমেন্টেড’ হওয়া প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশে কারা রাজনীতি করবে, কোন আদর্শের ভিত্তিতে করবে তা নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। অন্তত পাকিস্তানি ভাবধারার কোনো রাজনৈতিক দলের রাজনীতি এ দেশে কাম্য নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সেটি সন্নিবেশিত হয়েছিল।
সুষ্ঠুধারার সভ্য সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের জন্য অসভ্যতার ইতিহাস জনসমক্ষে প্রকাশিত হওয়া দরকার। হত্যা নয়, রাজনীতির মাঠে চলুক সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। ভণ্ডামি নয়, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার আলোয় মানুষের চেতনা আন্দোলিত করা হোক। বাইরের ষড়যন্ত্রকারী প্রভু নয়, বাংলার জনগণই হোক রাজনৈতিক শক্তির উৎস। পরাজিত সাম্প্রদায়িকতা নয়, বাঙালির মানবতাবাদী দর্শনই হোক রাজনৈতিক দলগুলোর মূলমন্ত্র। আর এ হোক এবারের আগস্টের শপথ।
সহযোগী অধ্যাপক; ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mrahim77@du.ac.bd
Posted ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১১ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin