‘তোরে খাইয়া ফালামু’—ঠিক এভাবেই শিক্ষক রাসেল রানাকে (২৮) পুলিশের সামনে বীরদর্পে বলেছিলেন গাজীপুরের শ্রীপুর থানার তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি ইমরান হোসেন (২৩)। কারবারি ইমরান ঠিকই ১১ দিন পর রাসেলের জীবন কেড়ে নিয়েছেন। মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রাসেল রানাকে বাঁচতে দেননি তিনি।
গত ২৫ আগস্ট পুলিশ ইমরানকে আটক করেছিল। মাদক কারবারের তথ্য দেওয়ার সন্দেহে আটকের পর পুলিশের সামনেই শিক্ষক রাসেল রানাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন ইমরান। কিন্তু ওই সময় পুলিশ ছিল নির্বিকার। এর কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ ক্যাম্প থেকে ইমরানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাড়া পেয়েই পরদিন রাসেল রানার বাড়িতে গিয়ে ফের হুমকি দিয়েছিলেন ওই মাদক কারবারি। এর ১১ দিন পরই তুলে নিয়ে রাতভর নির্যাতন চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে রাসেল রানার লাশ খালপারে ফেলে যান ইমরানসহ তাঁর সঙ্গীরা। স্বজনদের অভিযোগ, পুলিশের সামনে খুনের হুমকি দেওয়ার পরপরই ব্যবস্থা নিলে এ হত্যার ঘটনা হয়তো বা ঘটত না। গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘি গ্রামে রাসেল রানার হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য।
রাসেল রানা ওই গ্রামের সুজন আলীর ছেলে। তিনি পাশের বারোতোপা গ্রামের শিশুকানন বিদ্যানিকেতনের শিক্ষক ছিলেন। হত্যায় অভিযুক্ত ইমরান হোসেন দক্ষিণ বারোতোপা গ্রামের আবু বকর মণ্ডল ওরফে বাক্কা মণ্ডলের ছেলে। গত রবিবার সকালে দক্ষিণ বারোতোপা গ্রামের লবলং খালের (বিলাইঘাটা) পার থেকে রাসেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর শরীরজুড়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
এদিকে গত রবিবার রাতে রাসেলের বাবা সুজন আলী বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় ইমরান হোসেন ছাড়াও তাঁর সহযোগী আরো পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুজ্জামান খান জানিয়েছেন, ইমরান তাঁর পাঁচ-ছয়জন সহযোগীকে নিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। হত্যায় জড়িত ওই সহযোগীদের শনাক্ত করা হয়েছে। তবে ইমরানসহ সহযোগী সবাই পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। থানার মাদক কারবারিদের তালিকায় ইমরানের নাম রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট বিকেলে শ্রীপুরের মাওনা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মিজানুর রহমান সলিংমোড় থেকে ইমরানকে আটক করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আটকের সময় ২০-৩০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাসেল রানা। ওই সময় পুলিশের সামনে রাসেলকে ডেকে ‘তোরে খাইয়া ফালামু’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন ইমরান। ওই সময় পুলিশ রাসেলকে সরিয়ে দিয়ে ইমরানকে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে রাতেই পুলিশ তাঁকে ছেড়ে দেয়।
হুমকির প্রসঙ্গ স্বীকার করে এএসআই মিজানুর রহমান জানান, ইমরানকে আটকের সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। ইয়াবা থাকার তথ্য পেয়ে তাঁকে জানিয়ে দুজন কনস্টেবল ইমরানকে আটক করেছিলেন। কিন্তু দেহ তল্লাশি করে ইয়াবা পাওয়া যায়নি। ওই সময় পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন সন্দেহে রাসেলকে হুমকি দিয়েছিলেন ইমরান। হুমকির বিষয়টি জেনে ইমরানকে ক্যাম্পে নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘রাতে অভিভাবকসহ তাঁদের (ইমরান) ঘনিষ্ঠ পুলিশের একজন কর্মকর্তা ক্যাম্প থেকে ইমরানকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।’
তবে মাওনা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) সোহেল রানা বলেন, ‘দেহ তল্লাশি করে ইয়াবা না পাওয়ায় ইমরানকে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের জিম্মায় দেওয়া হয়।’ পুলিশের সামনে রাসেলকে হুমকি দেওয়াসহ ইমরান থানার তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি কি না জানতে চাইলে ক্যাম্প ইনচার্জ সোহেল রানা বলেন, ‘আমার জানা নেই।’
রাসেল রানার বাবা সুজন আলী বলেন, ‘পুলিশের সামনে হুমকি দেওয়ার পর ইমরানকে ছেড়ে না দিয়ে যদি ব্যবস্থা নিত, তাহলে রাসেলকে মরতে হতো না।’ তিনি জানান, পুলিশ ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়ে পরদিন তাঁর বাড়িতে গিয়েও হুমকি দিয়েছিলেন ইমরান।
রাসেল রানার চাচাতো ভাই সরোয়ার হোসেন জানান, তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা মাওনা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের কনস্টেবল মফিজকে বারবার ফোন করে জানিয়েছিলেন। একপর্যায়ে ফোনসেট বন্ধ করে রাখেন মফিজ। সরোয়ার অভিযোগ করেন, ক্যাম্পের পুলিশ তাত্ক্ষণিক তৎপর হলে রাসেলকে জীবিতই উদ্ধার করতে পারতেন।
Posted ৪:১৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin