‘আমি হলফ করে বলতে পারি, মুজফ্ফরকে দেখলে লোকের শুস্ক চক্ষু ফেটে জল আসবে। এমন সর্বত্যাগী, আত্মভোলা, মৌন কর্ষ, এমন সুন্দর প্রাণ, এমন ধ্যানী দূরদৃষ্টি, এমন উজ্জ্বল প্রতিভা, এমন উদার বিরাট বিপুল মন নিয়ে সে কী করে জন্মাল বাংলায়, তা ভেবে পাইনে!’ কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ সম্পর্কে এ মন্তব্য করেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ থেকে ১৩২ বছর আগে ব্রিটিশ-ভারত আমলে মুজফ্ফর আহ্মদ চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতার হুগলী মুহসীন কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন ক্লাস করেন। তবে পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ পাননি।
আর্থিক দৈন্যের কারণে মুজফ্ফর আহ্মদ উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। প্রেসে কাজের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। সাহিত্য না রাজনীতি; কোনটি গ্রহণ করবেন- এই দ্বন্দ্বে তিনি দুটিকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে বেড়ে ওঠেন সাহিত্যিক ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে।
মুজফ্ফর আহ্মদ পরবর্তী সময়ে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পান। এ সময় লেখার সুবাদে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি ‘সাপ্তাহিক নবযুগ’, ‘গণবাণী’ পত্রিকারও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২২ সালে মুজফ্ফর আহ্মদ একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন তিনি। তার অক্লান্ত চেষ্টায় তখন কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এতে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েন তিনি। ১৯২৩ সালের মে মাসে ‘পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’ মামলায় আসামি করে বন্দি করা হয় তাকে। কিন্তু প্রমাণ না পাওয়ায় তিনি মুক্তি পান। ১৯২৪ সালে ‘কানকুন কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র’ মামলায় তাকে চার বছরের দণ্ড দেওয়া হয়।
মুজফ্ফর আহ্মদের ইতিহাস ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস। সংসার জীবন ত্যাগ করে আজীবন সংগঠনের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে নিবেদিত করেন। অত্যাচার, নির্যাতন, কারাগার, হুলিয়া- কোনো কিছুই তাকে সংগঠনের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তাকে বঙ্গীয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতির দায়িত্ব প্রদানের আহ্বান জানানো হতো। কিন্তু কখনও তিনি তা গ্রহণ করেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি সহসভাপতির দায়িত্ব গ্রহণে সম্মতি দিয়েছিলেন। সুভাষ বসু তখন ছিলেন সভাপতি।
ওই সময় ভারতবর্ষের প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনগণ মুজফ্ফর আহ্মদের রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। তখন এই মতবাদ ভারতবর্ষে রাজনৈতিক গগনে এক অত্যুজ্জ্বল শক্তি হিসেবে এসেছিল। যার প্রভাবে ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে লেনিনের আদর্শে কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। ওই সময় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন অত্যন্ত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন অনেকে চিন্তা করতেন, অদূর ভবিষ্যতে লেনিনের আদর্শে গড়ে উঠবে উপমহাদেশের দেশগুলো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে আশা নিভে যায়। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের শত চেষ্টা, শত আশা, তার আদর্শে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলন যেন স্তিমিত হয়ে এলো।
আমাদের দেশে মুজফ্ফর আহ্মদকে তেমন স্মরণ করা হয় না। কিন্তু ভারতে তিনি এখনও স্মরণীয়। কলকাতায় রিপন স্ট্রিটের নাম পরিবর্তন করে মুজফ্ফর আহ্মদ সরণি রাখা হয়েছে। মহাজাতি সদনে রবীন্দ্রনাথ ও নেতাজি সুভাষ বসুর সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদের তৈলচিত্র স্থাপিত হয়েছে। কলকাতায় সিপিআইর (এম) প্রধান দপ্তর ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে মুজফ্ফর আহ্মদ ভবন। এখানে স্থাপিত হয়েছে তার প্রস্তর মূর্তি। ১৯৮৯ সালের ৫ আগস্ট মুজফ্ফর আহ্মদ শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আইনসভায় তার প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে।
মুজফ্ফর আহ্মদ ছিলেন সততার উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেশ, মানুষ ও মানুষের কল্যাণে নিজের পুরো জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান ও সহযোগিতা আমরা সব সময় স্মরণ করি। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ৮৪ বছর বয়সে এই মহান নেতার চিরবিদায় ঘটে। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা হিসেবে তিনি সব সময় স্মরণীয়।
Posted ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin