অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ একটা সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। স্লো ও লো উইকেট হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলে দুই দল। বোলারদের পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে যেটা, সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলেছেন তরুণরা। যে কারণে দলগত পারফরম্যান্সের সুফল পেয়েছে টাইগাররা। সদ্য সমাপ্ত এই সিরিজের পারফরম্যান্স নিয়ে নিয়ে বিশ্নেষণ করেছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বিশ্নেষণের আলোকে বিকেএসপির এই ক্রিকেট উপদেষ্টা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজকে টি২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতির মঞ্চ বানাতে বলছেন। কন্ডিশন এবং দল দুটোই বিশ্বকাপকেন্দ্রিক করার পরামর্শ তার।
সব মিলিয়ে সিরিজটা ভালো হয়েছে। কারণ আমরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেছি। অসিদের কয়েকজন মূল ক্রিকেটার না থাকলেও বাকিরাও প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়। তারাই ভবিষ্যতের রিপ্লেসমেন্ট। সেদিক থেকে একদম নতুন দল নয়। নিঃসন্দেহে তাদের মূল দল আরও শক্তিশালী। এই দলটিও ভালো। হ্যাঁ, এটা সত্যি কন্ডিশন আমাদের সাহায্য করেছে। অনেকে বলছে, এটাই আমাদের উইকেট। আসলে আমরা এরকম উইকেটে খেলি না। ব্যাটসম্যানদের কিন্তু কষ্ট করে রান করতে হয়েছে। ভালো উইকেট হলে আমরাও ভালো খেলি জিম্বাবুয়েতে সেটা দেখা গেছে। সদ্য খেলা সিরিজে কোয়ালিটি বোলিংয়ের বিরুদ্ধে খেলেছেন ব্যাটসম্যানরা। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনার, মিডিয়াম পেসার ও ফাস্ট বোলার সবাই সলিড। টপ ক্লাস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে খেলতে হয়েছে। সুবিধা যেটা পেয়েছি ওদের ব্যাটসম্যানরা এই কন্ডিশনে ভালো করতে পারেনি। কন্ডিশন তাদের কিছুটা ব্যাকফুটে রাখায় আর আমাদের বোলাররা খুব ভালো বোলিং করায় সিরিজ ৪-১ করা সম্ভব হয়েছে। ওভারে একটা-দুটা হাফ ভলি, ফুলটস দিলে জিততে পারতাম না। সাকিব আল হাসানের একটি ওভার ছাড়া সিরিজজুড়েই বোলাররা দুর্দান্ত বোলিং করেছে। যেটা ওদের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করায় নিজেদের মতো করে খেলতে পারেনি।
জিম্বাবুয়ে সফর থেকে দলে ইতিবাচক মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। সেরা ক্রিকেট খেলে জিততে চেষ্টা করেন খেলোয়াড়র। দলগত এই পরিবর্তনের কারণে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যেটা খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে ওপরে নিয়ে গেছে। পরের সিরিজগুলো ইতিবাচক মাইন্ড সেট নিয়ে খেলতে পারবে যে কোনো কন্ডিশনে, যে কোনো দলের বিপক্ষে। এককথায় দলটাকে গোছানো মনে হচ্ছে। এর কারণ হতে পারে, দল গোছাতে কোচ দুই সিরিজ ধরে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করছেন। টপঅর্ডার, মিডল অর্ডার, লেট মিডল অর্ডার ব্যাটিং সাজানো-গোছানো। পাওয়ার প্লে, স্লগ ওভারের বোলিংও হয়েছে ছকে বাঁধা। ব্যাটিংয়ের ওপেনিং ভালো না হলেও বাকিরা ছকে ছিল। এটাকে আরও উন্নত করা গেলে বাংলাদেশ শক্তিশালী টি২০ দল হয়ে উঠবে।
এই সিরিজে মুস্তাফিজ আশাতীত ভালো করেছে। তার এ ধরনের বোলিং আগে কখনও দেখিনি। ও বোধহয় ওর সত্যিকারের শক্তির জায়গায় যেতে পেরেছে। ডট বল ও ইকোনমি রাখার লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিল, নয়তো গোল ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। আগে যেটা করত, হঠাৎ করে একটা বাউন্সার, ইয়র্কার বা ওয়াইড স্টাম্প ডেলিভারি দিত। বিভিন্ন রকম বল করত। আমার মনে হয়, প্রতি বলে উইকেট নেওয়ার চিন্তা করত। সে বুঝতে পেরেছে, একটা প্রসেস মেনে বোলিং করলে উইকেট অটোমেটিক্যালি চলে আসবে। ওর উইকেট কম পাওয়ার কারণ যথেষ্ট রান ছিল না স্কোর বোর্ডে। কম রান থাকায় ওকে কেউ সেভাবে চার্জ করেনি। রান বেশি থাকলে মুস্তাফিজকেও চার্জ করলে উইকেট পেত। মুস্তাফিজের বোলিংকে অন্য লেভেলে দেখলাম। সে আবার যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে, একই ছন্দে হয়তো পাওয়া যাবে না। সব কন্ডিশনে ৮ বা ১০ রান দিয়ে চার ওভার শেষ করতে পারবে, সেটা আশা করাও ঠিক হবে না। শরিফুলও খুব ভালো বোলিং করেছে। খুব তাড়াতাড়ি শিখছে সে। ওর সাহস, পজিটিভ মানসিকতা ভালো দিক। চাপ হ্যান্ডেল করা শিখছে। চাপটা বোধহয় উপভোগও করে। চাপ যত আসে ও তত বেশি ফোকাসড হয়। এটা সবার হয় না। ওর এটা অনেক বড় গুণ ওর। হ্যাঁ, তরুণ হওয়ায় একটু টেম্পারমেন্ট কাজ করে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো খেলবে। কারণ ওর সব জিনিসই ভালো। নাসুমের কথা বলতে হয়। এবার পুরো একটা সিরিজ খেলার সুযোগ পেল। একটা জিনিস হয়তো খুব কাজে লেগেছে। স্কোয়াডের খেলোয়াড়রা যখন জানল বাবলের কারণে বাইরে থেকে কেউই যেতে পারবে না, তখন নিরাপদ বোধ করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, সেই খেলবে যেটা ভালো খেলতে সাহায্য করেছে। নাসুম ভালো বোলার, তার দলকার ছিল আত্মবিশ্বাস, সেটা সে পেয়েছে। আফিফের আত্মবিশ্বাস এবং ইমপ্যাক্ট দুটোই আছে। যে কোনো সময় ছয় মারতে পারে, বাউন্ডারি বের করতে পারে, সিঙ্গেলও নিতে পারে। স্পিন, পেস সব ধরনের বলে খেলতে পারে। বড় ক্রিকেটার হওয়ার সব গুণই আছে তার। সে নিজেকে কোথায় দেখতে চায় তার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। সোহানও অনেক ভালো খেলেছে। ওর ব্যাপারে একটা ভয় ছিল, লিগে যেভাবে খেলে ওই খেলাটাই খেলতে পারবে কিনা। ওই খেলাটাই খেলেছে। ঢাকা লিগে বিপক্ষ দলকে যেভাবে দেখে এখানেও সেভাবেই দেখেছে। এটা খুবই ভালো কাজ করেছে। আমি আশাবাদী, টি২০ এবং ওয়ানডেতে খুব কার্যকর হবে ওর ব্যাটিং। আফিফও তাই। মেহেদী খুবই স্মার্ট একজন খেলোয়াড়। লিগ থেকে উঠে এসেছে। যে কারণে ওর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া ন্যাচারাল।
ও যতটুকু জানে সেটা নির্ভয়ে পারফর্ম করার চেষ্টা করে। এই মাইন্ড সেটাটাই ওকেই এই জায়গায় নিয়ে এসেছে।
যে কন্ডিশনে খেললাম সেটাকে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি বলা যাবে না। এই উইকেট বিশ্বকাপে থাকবে না। স্পিনার খেলবে দু’জন, পেসার খেলবে হয়তো তিনজন। এক প্রান্তে স্পিনার রাখলে অন্য প্রান্তে পেসার রাখতে হতে পারে। দলের গঠন, কৌশল বদলে যাবে। আমরা যে কৌশল নিয়ে এখন খেলি বিশ্বকাপে গিয়ে যদি একই কৌশলে না খেলি তাহলে বুঝতে হবে প্রস্তুতিটা অন্য ধরনের হচ্ছে। যেটা এখন জরুরি সামনের সিরিজে বিশ্বকাপের মতো উইকেট বানানো। বিশ্বকাপে যে রকম দল হবে সে রকম দল নিয়ে খেলা। নিউজিল্যান্ডের পরে তেমন কোনো খেলা থাকবে না। এটাই শেষ সুযোগ বিশ্বকাপের দল এবং কৌশল নিয়ে খেলার। রেজাল্ট কী হবে, সেটা নিয়ে মোটেই যেন চিন্তিত না হই। নিউজিল্যান্ডের মূল দল না আসায় কর্তৃপক্ষকে একটু সাহস নিয়ে ভালো উইকেট বানাতেও পারে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের সেরা দলের কাছাকাছি যারা থাকে তারাও খুব ভালো। ভালো উইকেট পেলে তারা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারবে। টিম ম্যানেজমেন্ট দল ও খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন করতে পারবে। সেটা না করলে, খুব ভালো খেলছি এই ফলস কনফিডেন্স নিয়ে বিশ্বকাপে গেলে কিছু করার থাকবে না। আসল খেলা কিন্তু বিশ্বকাপে। এখানে যতই ভালো খেলি না কেন, ওখানে ভালো না করলে কোনো অর্থ থাকবে না।
আমাদের মতো দলে অত নামকরা খেলোয়াড় নেই। আমরা দল হিসেবে খেলতে পারলে খুব ভালো হবে। দুটো সিরিজেই কিন্তু দেখলাম একক কোনো খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করেনি। সবাই অবদান রাখার চেষ্টা করেছে। সবাই মনে করেছে তারও অবদান রাখার সুযোগ আছে। মাহমুদুল্লাহ ও সাকিবের মধ্যে খুবই ভালো বোঝাপড়া দেখা গেছে। মুশফিক যখন আসবে তার সঙ্গেও হয়তো সেটা গ্রো করবে। এই জিনিসটা খুবই দরকার। সিনিয়রদের মধ্যে সম্পর্ক যত ভালো হবে নতুন খেলোয়াড়রা তত বেশি ভালো খেলবে। ওরা নিরাপদ বোধ করবে। আমাদের সংস্কৃতি কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো নয়। ওদের ওখানে সবাই সমান। আমাদের এখানে বড়রা বড়ই থাকে। এখানে সাকিব বা মাহমুদুল্লাহর সামনে কেউ দাঁড়াতে সাহস পাবে না। এই সম্মানের সম্পর্কটাকে কাজে লাগাতে হবে। সম্মান ও স্নেহের মেলবন্ধন হলে দারুণ জেল তৈরি হবে। এটাও দেখার বিষয়।
Posted ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১১ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin