রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ছুটি’ গল্পে কিশোর ফটিকের মানসিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।’ সত্যিই তাই। কৈশোরে শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মনোরাজ্যেও এক ধরনের পরিবর্তন আসে। এই সময়কে বলা হয় বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় শিশু-কিশোরদের প্রয়োজন বিশেষ যত্ন ও মনোযোগ। পরিবারের সদস্যদের স্নেহ-ভালোবাসা, যত্ন আর মনোযোগের যদি কোনো ঘাটতি এই বয়সে হয় তবে বিশাল অন্ধকার এসে গ্রাস করতে পারে অপার সম্ভাবনাময় একটি কিশোরকে। এই সময়ে তাদের মানসিক বিকাশের পথে অন্তরায় যে কোনো সমস্যা যেমন- শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, পরিবারে অপরাধের উদাহরণ, মাদকাসক্তি, সামাজিক অস্থিরতা কিংবা যে কোনো ধরনের মানসিক রোগ ঠেলে দিতে পারে বিচ্যুত আচরণের দিকে। আর তখনই এই কিশোর সমাজের চোখে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হয়। এ ছাড়া ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী কেউ যদি আইনবিরোধী কাজ করে তবে তাকে কিশোর অপরাধী বলে গণ্য করা হয়। কিশোররা বিচ্যুত আচরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে কিশোর অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করার সুযোগ পায়।
একটা সময় কিশোর অপরাধ বলতে চুরি, ছিনতাই, স্কুল পালানো কিংবা বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার মতো বিচ্যুত আচরণকেই বোঝাত। বর্তমানে আধুনিক নাগরিক জীবন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা, নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা, গঠনমূলক সংস্কৃতিচর্চার অভাব, বাবা-মায়ের কর্মব্যস্ততা কিশোরদের অনেকটা কোণঠাসা করে ফেলেছে। এই সুযোগে তারা বিভিন্ন ধরনের গেম, পর্নোগ্রাফি ও সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তা ছাড়াও বৈশ্বিক মহামারির এই কঠিন সময়ে শিশু-কিশোরদের গৃহবন্দি সময়কে আনন্দমুখর করতে অভিভাবকরা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন আধুনিক প্রযুক্তির সব সুবিধা। সন্তানকে দিচ্ছেন আলাদা কক্ষ। হয়তো এই বিষয়গুলোই কিশোরদের কখনও কখনও বিচ্যুত আচরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
কৈশোরে শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনও হয়। এ যেন মানুষের জীবনের এক কঠিন সময়। এই বয়সে কিশোরদের কাজ-কর্ম, চিন্তাভাবনা, আচার-ব্যবহারে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়। এ সময় প্রচলিত নিয়মের বাইরে সে বেরিয়ে আসতে চায়। এ পরিস্থিতিতে কিশোর তার মানসিক প্রক্ষোভগুলো হয় অবদমন করে নিজেকে এর প্রভাব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে অথবা উৎকর্ষণের মাধ্যমে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যখন একজন কিশোর যায় তখন তার জন্য প্রয়োজন সঠিক ও স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষ তার নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়। চারপাশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানে ও আত্মস্থ করে এবং সমাজের অন্যদের প্রত্যাশিত আচরণ সম্পর্কে অবগত হয়। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোররা সমাজে তার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।
এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া দারুণভাবে ব্যাহত হয় যদি পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয় কিংবা বন্ধনহীনতার মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দেয়। একই বিষয়ের অবতারণা করা যায় সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রেও। ব্যক্তির সঙ্গে যখন সামাজের সম্পর্ক ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে বা ভেঙে যায়, তখনই তার অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এই বন্ধনগুলো দৃঢ় হবে সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং সামাজিক প্রথা-পদ্ধতি ও মূল্যবোধ আত্মস্থ করার মাধ্যমে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন যত সুদৃঢ় হবে, সামাজিক ও পারিবারিক বিচ্যুতি তত কম হবে।
সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিশোরদের সঠিক সামাজিক এবং মানসিক বিকাশ সম্ভব। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির কৈশোর-মানস, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আচার-অনুষ্ঠান আয়ত্ত করে। তবে যদি সে পরিবার ও সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকে কিংবা পরিবারে স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই কিশোর-কিশোরীদের মানসিক প্রক্ষোভগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তা ছাড়া বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য ছাড়াও আত্মীয়স্বজন সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব, স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠী, প্রতিবেশী- প্রত্যেকেই কিশোর-কিশোরীদের মানসিক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অপরাধবিজ্ঞানী জেমস উইলসন তার ‘ভাঙা জানালাতত্ত্ব’র জন্য সুপরিচিত। তিনি ১৯৮২ সালে তার প্রবন্ধটিতে উল্লেখ করেছেন, যে কোনো ধরনের ছোটখাটো অপরাধকে সঙ্গে সঙ্গেই দমন বা প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে এখান থেকেই বড় ধরনের অপরাধের শঙ্কা রয়ে যায় বা ঘটার পথ তৈরি হয়। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, কেউ যদি কখনও ঢিল মেরে কোনো বাসার জানালা ভেঙে দেয়, আর বাসার মালিক দ্রুত তা ঠিক করে না নেয় তাহলে অপরাধী ধরে নেবে- মালিক এ বাসায় থাকে না অথবা বাসার মানুষদের নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা নেই। এখানে সুস্পষ্ট, উইলিয়াম জানালাকে রূপক অর্থে দেখিয়েছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সমাজের ছোটখাটো অপরাধগুলো যদি আমরা বাড়তে দিই বা প্রতিহত না করি বা এড়িয়ে যাই তখন অপরাধীরা বড় ধরনের অপরাধ করার সুযোগ পেয়ে যায়। যে কোনো সমাজের জন্যই তাই কিশোর অপরাধ একটি সমস্যা। একে ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না করে আমাদের সমষ্টিগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পরিবার থেকেই প্রথমে এ সমস্যা সমাধানে চাপ সৃষ্টি হওয়া উচিত। কারণ পারিবারিকভাবে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
Posted ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin