কর্তাব্যক্তিরা অহোরাত্র দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয় আওড়ালেও চারদিককার নিত্যদিনের পরিস্থিতি দেখে মানুষ তাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। যেখানে টাকা, সেখানেই দুর্নীতি। যেখানে উন্নয়ন প্রকল্প, সেখানেই দুর্নীতি- যেন দেশটা একটি বিশাল বৃক্ষ। ওই বৃক্ষে ধরে আছে অজস্র দুর্নীতির সুযোগে ভরা নানা প্রকল্পের সমারোহ।
দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে বাইরে যেতেই হয়। তা সে হাঁটাপথেই হোক, বা অন্যবিধ যানবাহনে হোক। যানবাহন চলে সড়ক-মহাসড়ক-সেতুর ওপর দিয়ে। এই সড়ক-সেতুর ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি প্রচারিত হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। হাত দিয়ে তুলতে চাইলেই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কের পিচের আমূল উঠে আসছে। দৃশ্যমান হচ্ছে ইটের খোয়া। সাক্ষাৎকারে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। হয়তো আবার তহবিল আসবে, মেরামত হবে। কিন্তু সড়কের মান যা তা-ই থেকে যাবে। কোথায় প্রকৌশলী, কোথায় প্রজেক্ট অফিসার, আর কোথায়ই বা সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রী বা সচিব!
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নীরব। ছোটখাটো রাস্তা-সেতু উদ্বোধন করে তাদের ‘উন্নয়নের সরকার’ বলে প্রশান্তি গাইতেও শোনা যায়। কিন্তু সেতুটি যে নির্মাণকাজ সমাপ্তির পর তিন দিন যেতে না যেতেই ধসে পড়ল- সে সন্ধান কে রাখে! পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা, আন্তর্জাতিক মহলের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশেই সড়ক ও সেতু নির্মাণ ব্যয় গোটা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক। যদিও বাংলাদেশেই শ্রমিক সর্বাপেক্ষা সস্তা। ইট, সুরকি, সিমেন্ট, বালিসহ তাবৎ উপকরণও বাংলাদেশে সস্তা। তা হলে কোন যুক্তিতে সড়ক-সেতু নির্মাণে এ দেশে সর্বাধিক ব্যয় হয়? এর উত্তর কর্তাব্যক্তিদের জানা। কিন্তু অজানা কারণে তারা নীরব।
‘আঁধার ঘরে সাপ, সকল ঘরে সাপ’- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে প্রবাদটি যথোপযুক্তই বটে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের। অর্থাৎ বিনামূল্যে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। কিন্তু দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা কী? হাসপাতালে ভর্তি হতে টাকা, অপারেশন করতে টাকা। বেড পেতে এবং তা দুই বেলা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করাতেও টাকা। যদিও সরকারি হাসপাতালে এসব খাতে কোনো ব্যয় হওয়ার কথা নয়। জেলা-উপজেলায় ৩০-৪০ বছর আগে যে ধরনের পরিকল্পনা ও অবকাঠামো নিয়ে সরকারি হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে, সেগুলো এখনও আগের অবস্থায় আছে। ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালগুলোকে ১০০০ শয্যার হাসপাতালে এবং ৩০ শয্যার উপজেলা হাসপাতালগুলোকে কমপক্ষে ১০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা প্রয়োজন। জনসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধি এবং নিত্যনতুন কঠিন রোগের প্রাদুর্ভাবে এই প্রয়োজন সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারলেও কর্তাব্যক্তিরা তা উপলব্ধি করছেন বলে মনে হয় না। হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা কম থাকার কারণেই যে বেড কেনাবেচা হয়, অপারেশন চার্জ বহু গুণ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়- তা বুঝতে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। করোনা স্বাস্থ্য খাতের প্রকৃত চেহারা স্পষ্ট করেছে। দুর্নীতিবাজ অনেকের নাম শিরোনামে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে একটি কথাই সম্ভবত যথেষ্ট। আর তা হলো- সর্ব অঙ্গে ব্যথা, মলম দেব কোথা?
আমাদের শিক্ষা খাত বাজেটে বরাবরই উপেক্ষিত থাকে। প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষায় যে বরাদ্দ হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার যা বরাদ্দ হয় তা শিক্ষার মানোন্নয়নে তেমন ব্যয় হয় না। ব্যয় হয় মূলত অবকাঠামো নির্মাণে। আর অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ প্রভৃতি তৈরিই হলো এ খাতের সর্বাধিক দুর্নীতির উপায়। বাদ-বাকি যা খরচ হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং বিনামূল্যে বিতরণের জন্য কোটি কোটি কপি পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ বাবদ। আমাদের শিক্ষার মান ক্রমেই তলানির দিকে যাচ্ছে। এর মূল কারণ শিক্ষকদের দক্ষতায় ঘাটতি। আমাদের শিক্ষকরা জীবিকার নিশ্চয়তা থাকার পরও নিজেদের সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেন না। তাদের অনেকেই আবার কোচিং সেন্টার খুলে বসেন; টিউশনিতে আত্মনিয়োগ করেন। এ অবস্থায় শিক্ষকদের নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা বিভাগের নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। একই সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে প্রায় সব পর্যায়ে যে ব্যাপক দুর্নীতি প্রচলিত রয়েছে, যে কোনো মূল্যে তার শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে।
ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও ব্যর্থতার ফলে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের গুরুতর অপচয় ঘটছে। তা বন্ধ করার ক্ষেত্রে যে নির্লিপ্ততা দেখা যায়, তার ফলে লাখো কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সততা বহুকাল ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। থানাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জনভোগান্তির অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা গ্রহণ সচরাচর পরিলক্ষিত হয় না।
মাত্র কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘হেফাজত নেতাদের অবৈধ অর্থ কত’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়- “হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ব্যয় হিসাবের ‘অবৈধ অর্থের’ সন্ধানে নেমেছে ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট। এর অংশ হিসেবে সংগঠনটির ৯৮ নেতাকর্মীর ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” ধর্মীয় কাজের নামে দেশ-বিদেশ থেকে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ, সেই টাকায় অতিমাত্রায় বিলাসী জীবন, প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ভাড়া করে ওয়াজ বা দূরবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত- এ জাতীয় তথ্য মানুষকে বিস্মিত করেছে। বাবুনগরীসহ অভিযুক্ত হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা থাকা সত্ত্বেও তাদের গ্রেপ্তারের ঊর্ধ্বে থাকার বিষয়টি আজ ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
জামায়াতে ইসলামীর মূল নেতারা গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারে ফাঁসির আদেশ হলে তা কার্যকর করা হয়। কিন্তু ওই নেতাদের ১৯৭১ সালে ও তার আগে অর্জিত সম্পদ, অপরাপর জামায়াত নেতার সম্পদ অনুসন্ধান করার দাবিও উপেক্ষিত। খোদ জামায়াতে ইসলামী নামের ব্যাংক হিসাব ও অন্যান্য সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবিও শূন্যেই মিলিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ের প্রতিবিধান করতে অবৈধভাবে অর্জিত ও বিদেশে পাঠানো অর্থ উদ্ধার করলে বাংলাদেশে কোনো অভাব এবং দরিদ্র থাকত না।
Posted ৬:২১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৫ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin