পদ্মা সেতু তৈরি করতে গিয়ে পদ্মার দুই পারে ভাঙা-গড়ার খেলা কম হয়নি। উভয় পারের স্থানীয় বাসিন্দাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারাতে হয়েছে, ঘরবাড়ি ভাঙতে হয়েছে, হাতছাড়া হয়েছে কৃষিজমি। এ চিত্র পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর দিকের। আরেক দিকের চিত্র ঠিক তার উল্টো। সেই ভিটেহারা, ঘরহারা মানুষগুলোই পেয়েছেন নতুন করে মাথা গোঁজার ঠাঁই। ঘরহারাদের নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে নতুন ঘর, জমিহারাদের দেওয়া হয়েছে নগদ অর্থ। পদ্মা সেতুর কারণে ভিটা-বাড়িহারাদের জন্য সরকার দুই পারে মোট ৭টি পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করেছে। এখানে ২৮শ পরিবার বসবাস করছে। আর এই ২৮শ পরিবারের সুখের ঠিকানা এখন এই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো।
পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে বসবাসকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কাছে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো সুখের ঠিকানা এ জন্যই যে পদ্মা পারের তাদের আগের জীবন আর বর্তমানে পুনর্বাসন কেন্দ্রের জীবনে আকাশ-পাতাল তফাত। কেননা আগে পদ্মা নদীর ধারে তাদের অধিকাংশেরই বসবাস ছিল টিনের খুপরি ঘর বা কাঠের ঘরে। তা ছাড়া প্রতিবছরই পদ্মার ভাঙনের কবলে হারাতে হতো ঘরবাড়ি। কিন্তু এখন মিলেছে পাকা দালানবাড়ি, বসবাসের জন্য সুন্দর ও ছিমছাম আধুনিক পরিবেশ। যেখানে নেই নদী ভাঙনের কোনো ভয়। তাই পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরুতে ভিটেমাটি যাওয়ার যে কষ্ট ছিল স্থানীয়দের মাঝে, সে কষ্ট এখন আর তাদের মাঝে নেই। সরেজমিন পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর জন্য জমি দেওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়েছে দুই পারে সাতটি। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে চারটি এবং শরীয়তপুরের জাজিরার পূর্ব নাওডোবায় ৪ নম্বরটি, পশ্চিম নাওডোবার মাঝিরকান্দিতে ৬ নম্বরটি। আর মাদারীপুরের বাকরেরকান্দিতে রয়েছে ৫ নম্বর পুনর্বাসন কেন্দ্র। মাওয়া প্রান্তের চারটির মধ্যে কুমারভোগে দুটি ৩ ও ৭ নম্বর কেন্দ্র এবং মেদিনীমণ্ডলের যসলদিয়ায় দুটি ২ ও ৮ নম্বরটি। তা ছাড়া মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের দোগাছিতে রয়েছে ১ নম্বর পুনর্বাসন কেন্দ্র। এটি অবশ্য সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য না। এটি পদ্মা সেতুতে কাজ করা চীনা প্রকৌশলীসহ অন্য কর্মকর্তাদের জন্য।
সাতটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২৮শ পরিবার বসবাস করছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে রয়েছে পাঁচটি স্কুল ও পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রয়েছে ছয়টি নান্দনিক মসজিদ। রয়েছে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ২৮শ পরিবারকে এখানে পুনর্বাসন করেছে। তাই মানুষের সমাগমও বেড়েছে। পদ্মাতীরের জনপদের এখন চেহারা পাল্টে গেছে। আশ্রয় কেন্দ্রে নির্মাণ হয়েছে নান্দনিক ঘরবাড়ি। এখানে মানুষগুলো শান্তিশৃঙ্খলায় বসবাস করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে যারা জমি দিয়েছেন তারা জমির ন্যায্যমূল্যের চেয়ে বেশি টাকা পেয়েছেন। আবার পেয়েছেন এমন চমৎকার বাড়ি। উন্নত হয়েছে তাদের জীবনমান। তাই বদলে যাচ্ছে সব কিছু।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে মৌলিক কোনো পার্থক্য না থাকলেও সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে কিছু পার্থক্য আছে। কেন্দ্রগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবার মান নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই। কুমারভোগ পুনর্বাসন কেন্দ্রে বাজার স্থাপন করা হলেও সেখান কোনো বাজার বসে না।
অন্যদিকে যসলদিয়া কেন্দ্রে বাজার থাকলেও সেখানে মাছ ও শাকসবজি পাওয়া যায় না। কমিউনিটি সেন্টার নেই কোনো কেন্দ্রেই। যসলদিয়া কেন্দ্রে বাজার, স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র একসঙ্গে পাশাপাশি থাকলেও কুমারভোগ কেন্দ্রে সেসব রয়েছে একটি থেকে অন্যটি বেশ দূরে দূরে।
কুমারভোগ কেন্দ্রের বাসিন্দারা যসলদিয়া কেন্দ্রের বাসিন্দাদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে আর্থিক দিক থেকে ভালো আছেন। যসলদিয়া কেন্দ্রের বাসিন্দাদের কর্মস্থলে যেতে অনেক বেগ পেতে হয় রাস্তাঘাটের দুরবস্থার কারণে। এতে তাদের একদিকে যেমন ভোগান্তি রয়েছে, অন্যদিকে যাতায়াত ভাড়ায় বেশ খরচ হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় অনায়াসেই। কেন্দ্রের ভেতরে খালি জায়গায় শিশুদের জন্য রাইড নির্মাণ করে বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিষয় হলো এখানকার গাছ-গাছালির সবুজের সমাহার। বন বিভাগ থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতিটি রাস্তার দুধারে শুধু গাছ আর গাছ। একেবারে পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে এখানে। তা ছাড়া প্রতিটি পুনর্বাসন কেন্দ্র এখন পরিচালিত হয় সুশৃঙ্খলভাবে। এখানকার বাসিন্দারা নির্বাচনের মাধ্যমে একজন সভাপতি নির্বাচন করেন। সভাপতির নেতৃত্বে একটি পরিচালনা কমিটি আছে। কেন্দ্রগুলোর ভালো-মন্দ সবকিছুই দেখভাল করে এই কমিটি।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের কুমারভোগ ৩নং পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. শাহ আলী। কেন্দ্রের ভেতরেই বসে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় একটি চায়ের দোকানে। এ সময় দোকানটিতে আরও ৮ থেকে ১০ জন বাসিন্দা ছিলেন।
সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে তারা একেকজন একেকভাবে তাদের মনের কথা বলতে থাকেন।
শাহ আলী বলেন, আমাদের জমি গেছে, তাতে কষ্ট নেই। এর প্রধান কারণ স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। সেতুর দিকে তাকালে আমাদের গর্ব হয়। তা ছাড়া সরকার আমাদের জমি নিলেও, উন্নত জীবনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আগের আমাদের বসবাস করতে হতে ছোট ছোট খুপরি ঘরে। আর এখন পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রায় প্রত্যেকেই পাকা বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন। শুধু তাই নয়, এখানে কেউ আড়াই কাঠা, কেউ ৩ কাঠা, আবার কেউ ৫ কাঠা জমি পেয়েছেন। সেখানে অনেকেই চার তলা-পাঁচ তলা বাড়ি তৈরি করেছেন। সেখানে নিজে বসবাস করছেন, আবার ভাড়া দিয়ে টাকা আয় করছেন। সুতরাং এই পুনর্বাসন কেন্দ্র এখন আমাদের কাছে সুখের ঠিকানা।
এখানকার আরেক বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ঢাকার গুলশান-বনানী দেখিনি, কিন্তু শুনেছি সেখানকার মানুষরা উন্নত জীবনযাপন করেন। আমার কাছে মনে হয় আমরা এখন গুলশান-বনানীর মানুষের মতো উন্নত জীবনযাপন করছি। কারণ সেখানকার মতো আমাদের এখানেও রয়েছে আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনা, স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনা ও দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। বরং ঢাকার উন্নত জীবনের চেয়েও আমরা একধাপ এগিয়ে আছি। সেখানে কিন্তু এত সবুজায়ন নেই, যা আমাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে আছে। তাই আমরা এখানে বেশ সুখেই আছি।
তবে আবু সুফিয়ান নামে এক বাসিন্দা কিছুটা ক্ষোভ জানালেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের স্কুল নিয়ে। তার ভাষ্য, যখন কেন্দ্রগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো স্থাপন করা হয় তখন বলা হয়েছিল, কেন্দ্রে বসবাসরত শিক্ষিত বেকার যুবকদের স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু স্কুল হওয়ার পর সেটি করা হয়নি। স্থানীয়দের শিক্ষক হিসেবে না নিয়ে বাইরের লোকদের বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে এখানকার অনেক শিক্ষিক যুবক বেকার হয়ে আছেন।
তিনি আরেকটি বিষয় নিয়ে ক্ষোভ জানালেন। সেটি হলোÑ সরকার পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে জমি দিলেও সেগুলো আজ অবধি রেজিস্ট্রি করে দেয়নি। সে কারণে তাদের নানারকম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনের কেউ এখানকার জমি বিক্রি করতে চাইলে সেটি পারছেন না। তাই দ্রুত জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
প্রকল্প পরিচালকের ভাষ্য : এসব বিষয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, নানা জটিলতায় এত দিন পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর জমি বাসিন্দাদের নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়নি। তবে এখন সে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। প্রত্যেক বাসিন্দার কাছে জমিসংশ্লিষ্ট কাগজ চাওয়া হয়েছে বেশ আগেই। সেগুলো ইতোমেধ্যই যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। জমি রেজিস্ট্রি করার প্রক্রিয়া একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। হয়তো আগামী মাসের শুরুতেই রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শুরু করতে পারব।
তা ছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের স্কুলের শিক্ষক নিয়োগসহ অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, স্কুলগুলো সাধারণত এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
Posted ৩:১৩ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin