এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে পদ্মা সেতু। নির্মাণকাজের প্রায় ৯০ ভাগ শেষ হওয়ায় সেতুর পুরো অবয়ব এখন দৃশ্যমান। চলছে শেষ পর্যায়ের কাজের তোড়জোড়। দিন দিন পদ্মা সেতুর কাজ যতই সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, দুই পারের মানুষের জীবনের স্বপ্ন ততই বড় হচ্ছে। কারণ এই পদ্মা সেতুকে ঘিরেই তারা এখন জীবন বদলের ক্ষণ গণনা করছেন। পদ্মা সেতুর দুই কূলের মানুষের জীবন বদলে যেতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। তাদের আয়-রোজগার বেড়েছে, টিনের খুপরি ঘর থেকে ইট-পাথরের দালানে ঠাঁই মিলেছে, বেকারত্ব ঘুচে চাকরি মিলেছে, সর্বোপরি উন্নত জীবনের পালে হাওয়া দিয়েছে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর দুই কূল মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া, মাদারীপুরের শিবচর এবং শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকায় সরেজমিন ঘুরে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে মানুষের জীবনের পরিবর্তনের চিত্র।
আগে এসব এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি ও মৎস্য আহরণ। কিন্তু এখন এসব এলাকার শিক্ষিত বেকার-যুবকদের অনেকেরই চাকরি মিলেছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে। যার মাধ্যমে তাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে। আর যারা শ্রমজীবী মানুষ ছিল, তাদের কেউ ইঞ্জিনচালিত রিকশা চালাচ্ছে, কেউ সিএনজি চালাচ্ছে, কেউ দোকান দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়েছে। এতে করে আগে হয়তো সারাদিন কাজ করে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো, কিন্তু এখন তারা প্রতিদিন দেড় থেকে ২ হাজার টাকা রোজগার করছে। অর্থাৎ এখনই তিনগুণ আয় বেড়েছে পদ্মা পারের মানুষের। শুধু তাই নয়, এসব এলাকায় যারা বাড়িওয়ালা তাদেরও আয় বেড়েছে।
কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজ করা দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, শ্রমিক-কর্মচারীর সিংহভাগই থাকে এসব এলাকার বাড়িঘরে। দেখা গেছে, আগে যে বাড়িওয়ালার ভাড়াটিয়া মিলত না, এখন তার কোনো ঘরই খালি থাকে না। তা ছাড়া আগে এক রুম হয়তো দেড় হাজার বা দুই হাজার টাকায় ভাড়া দিত, এখন সেটি ভাড়া দিচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায়। পদ্মা সেতুর কাজ যখন শতভাগ সম্পন্ন হবে তখন দুই কূলের মানুষের আয় আরও বাড়বে। কারণ এসব এলাকায় গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা, পর্যটনকেন্দ্রসহ নানা রকম স্থাপনা, যাতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন পদ্মা সেতু জীবন বদলে দেবে দুই পারের মানুষের। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দুই পাশের জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর অর্থনীতি ব্যাপক চাঙ্গা হবে। এর আগে যখন যমুনা সেতু হওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিল মানুষ কর্মহীন হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল দুই পারে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল, কর্মসংস্থান হলো হাজার মানুষের। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। দুই কূলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের আর্থিক উন্নতি ঘটবে, মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। ইতোমধ্যেই দিনবদলের হাওয়া লেগেছে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এলাকার মানুষের জীবনে। তবে পদ্মা সেতুতে এখন অনেক স্থানীয় লোক কাজ করছে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর অনেকেই সাময়িক বেকার হবে। এজন্য প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে এসব লোকের কর্মসংস্থান করা যায় সেটি নিয়ে আগে থেকেই ভাবতে হবে সরকারকে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেরই জমি গেছে পদ্মা সেতুতে। যাদের ঘরবাড়িসহ নিজ জমি ছিল তারা নগদ অর্থের পাশাপাশি বাড়ি করার জন্য পুনর্বাসনকেন্দ্রে জমিও পেয়েছে। আর যাদের শুধু জমি গেছে তারা লাখ লাখ টাকা পেয়েছে। যদিও জমি অধিগ্রহণের টাকা পেতে উভয় পারের মানুষকে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও দালাল চক্রের কারণে। ঘুষ না দিলে হয়তো টাকা মেলেনি। তবুও পদ্মা পারের মানুষরা খুশি। কারণ তাদের এলাকায় তৈরি হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু। এই পদ্মা সেতু তাদের কাছে এখন গর্বের বিষয়।
লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ এলাকার বাসিন্দা আব্দুল গাফফার। পদ্মা সেতুতে তার জমি গেছে ৫ গণ্ডা (স্থানীয় হিসাবে ১ গণ্ডা সমান ৭ শতাংশ জমি) বা ৩৫ শতাংশ। মোট কত টাকা তিনি পেয়েছেন তা বলতে না চাইলেও তিনি জানান, টাকা তুলতে কয়েক জায়গায় ঘুষ দিতে হয়েছে।
তিনি জানান, প্রথমদিকে দুটি কারণে আমার খুব মন খারাপ হতো। এর একটি হচ্ছে বাপ-দাদার ভিটেসহ জমিটা চলে যাওয়া, অন্যটি হলো টাকা তুলতে গিয়ে ঘুষ দেওয়া। তবে এখন আর সে কষ্টগুলো মনের ভেতর নাই। কারণ পদ্মা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখি নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু, তখন আর কোনো কষ্টই মনে ঠাঁই পায় না। বরং এই সেতুকে ঘিরেই আমরা এখন দিনবদলের নতুন স্বপ্নে বিভোর।
একেবারে পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হয় লৌহজং উপজেলার দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড জেলে সমিতির সহসভাপতি মো. এমারত শেখের সঙ্গে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে তারও জমি গেছে বেশ খানিকটা; কিন্তু তাতে তার কষ্ট নেই। তিনি এখনও বাপ-দাদার পেশা মৎস্য আহরণ ছাড়তে পারেননি। কিন্তু তার দুই ছেলে কাজ করছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে। এতে করে তার আয় বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক। তিনি জানান, ‘পদ্মায় এখন মাছ তেমন একটা ধরা পড়ে না। তাই আমার রোজগার কমে গেছে। কিন্তু দুই ছেলে প্রজেক্টে কাজ করছে, তারা মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা বেতন পায়। তাদের আয়ে আমার সংসার এখন আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে চলছে। তাই আমার জমি গেলেও পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা খুশি।’
কুমারভোগ এলাকার আরেক বাসিন্দা কবীর হোসেন জানান, কুমারভোগ এলাকায় পুনর্বাসনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এখানে স্কুল, হাসপাতাল ও মসজিদসহ অনেক স্থাপনা তৈরি হয়েছে। এর আশপাশে নতুন বসতি গড়ে উঠছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। আমাদের জীবনমানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমার ছোটভাই আগে কৃষিকাজ করত, দিনে রোজগার করত ৫০০ টাকা। এখন কুমারভোগ এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে মুদি দোকান দিয়ে ব্যবসা করছে। এখন তার প্রতিদিন আয় ২ হাজার টাকার ওপরে। ব্যবসা করে এখন সে নতুন ঘরও তুলেছে। সুতরাং আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
পদ্মার পারে জাজিরার বাসিন্দা আনিসুর রহমান জানান, প্রতিবছর পদ্মার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবত আমার। এর আগে ভাঙনে ভিটেবাড়িও হারিয়েছি। কিন্তু পদ্মা সেতুর কারণে এই পারে বেড়িবাঁধ দেওয়ায় আমরা নদীভাঙন এবং বন্যার পানি থেকে রক্ষা পেয়েছি। তিনি জানান, শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ এগিয়ে চলায় দুই পারের বাসিন্দারা চোখের সামনে নতুন নগরায়ণ দেখছে। তাদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হচ্ছে। নগরায়ণের বাতায়নে পদ্মার দুই পারে গড়ে উঠছে নতুন হাটবাজার। তিনি জানান, সব মিলিয়ে আমরা এখন নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি।
Posted ৬:২৫ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin