মিরপুরজুড়ে চলছে ভয়াবহ চাঁদাবাজি। বিদেশে পালিয়ে থাকা, এমনকি কারাগারে বন্দি থাকা সন্ত্রাসীদের ফোন আসে ব্যবসায়ীদের কাছে। ফোন আসার পরই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। চাঁদার পরিমাণ কমাতে ভুক্তভোগীরা হাজির হন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিয়োগ করা স্থানীয় প্রতিনিধি সন্ত্রাসীদের কাছে। তাঁদের মাধ্যমেই চাঁদার পরিমাণ রফা করা হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় গুলি করার ঘটনাও ঘটে, না হলে ছাড়তে হয় এলাকা, হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। সব সন্ত্রাসীর ফোনের ভাষা একই—চাঁদা, না হয় জীবন। ভয় দেখাতে ছেলে-মেয়ে কোন স্কুলে পড়াশোনা করে, কোচিংয়ে কোন পথ দিয়ে যায়, আজ স্ত্রী কোন রঙের শাড়ি পরে বিপণিবিতানে গিয়েছে, তাও বলা হয়।
শুধু ব্যবসায়ীই নন, নির্বাচিত একজন কাউন্সিলরকেও জীবন বাঁচাতে চাঁদা দিতে হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে ফোন করেন হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, ম্যাসেঞ্জার ও সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করে। অনেক সময় বিদেশে অবস্থান করা ও কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের কথা বলিয়ে দেন তাঁদের প্রতিনিধিরা। মিরপুরের একাধিক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জানিয়েছেন, বিদেশে অবস্থান করা ও কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণ করে মিরপুরের রাজনীতিও। ফোন করে জানিয়ে দেয়, তাদের প্রতিনিধিদের কাকে দলের কোন পদে বসাতে হবে।
শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত একসময় মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। কয়েক ডজন খুনের আসামি শাহাদত ২০০৩ সাল থেকে বিদেশে থাকলেও আজও মিরপুর থানা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা যায়নি তাঁর ভয়ে।
১৯৯০ সালের দিকে একের পর এক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে ওঠে মিরপুরে। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ শীর্ষ সন্ত্রাসীর উৎপত্তিস্থল মিরপুরে। ডাকসাইটে সেসব সন্ত্রাসীর কেউ প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছে, কেউ বিদেশে পালিয়ে রয়েছে, কেউ কেউ কারাগারে। তবে জীবিত থাকা সন্ত্রাসীরা এখনো সক্রিয়। মিরপুরজুড়ে রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। ১৭ বছর ধরে কারাগারে থাকা কিলার আব্বাসের নিয়মিত গৃহভ্রমণ ও চার বছরের সন্তান থাকার ঘটনা প্রকাশ হয়েছে একাধিক গণমাধ্যমে।
একসময়ে মিরপুরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছাত্রদল নেতা সাইদুর রহমান নিউটন নিহত হন প্রতিপক্ষের হাতে। ভয়ংকর সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশ অবস্থান করছেন সুইডেনে। কালা জাহাঙ্গীর নিহত হয়েছেন বলে প্রচার হলেও তাঁর অনুসারীদের দাবি তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। ভয়ংকর সন্ত্রাসী শাহাদত অবস্থান করছেন ভারতে। ইব্রাহিমপুরের কিলার আব্বাস ১৭ বছর ধরে কারাগারে। অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী ভাসানটেকের ইব্রাহিম অবস্থান করছেন নেপালে।
বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসী দুই ভাই মামুন ও জামিল। মামুন নেপালে আর তাঁর ভাই জামিল রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে।
একসময়ে শাহাদাতের ক্যাশিয়ার পল্লবীর মোক্তার পরে নিজ নামেই একটি বাহিনী খুলে আলোচিত হয়ে ওঠেন। মোক্তার বর্তমানে বিদেশে। পল্লবীর সন্ত্রাসী চান রয়েছেন দেশের বাইরে, ভারতে।
মিরপুরের ভুক্তভোগী, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সরকারের একটি গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ সংঘটনের মূল হোতা ছয়জন। এঁরা হচ্ছেন শাহাদাত, মামুন ও তাঁর ভাই জামিল এবং ইব্রাহিম, কিলার আব্বাস ও চান। এঁরা প্রতিনিধি সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে চাঁদা আদায় করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নেন এবং দেশে থাকা পরিবারের কাছেও পৌঁছে দেন।
একসময়ে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল চরমে। গত বছর জানুয়ারিতে মিরপুরের একজন কাউন্সিলরের মধ্যস্থতায় তাদের বিরোধের মীমাংসা হয়। এর পর থেকে আদায় করা চাঁদার অর্থ ছয় শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে ভাগ হয়। তাঁদের পক্ষে ওই সমঝোতা ও অর্থ বিতরণের সমন্বয় করেন আলাউদ্দিন লাক্কু নামের এক যুবলীগ নেতা।
গত ঈদুল আজহায় ভাসানটেক ও কচুক্ষেত গরুর হাটের দরপত্র ক্রয় করেছিলেন ৪০ জন ব্যবসায়ী। কিন্তু কারাগার থেকে কিলার আব্বাসের ফোন ও তাঁর মাঠের সন্ত্রাসীদের হুমকিতে কেউ দরপত্র জমা দেননি। শেষ পর্যন্ত গরুর হাটের ইজারা দিতে হয়েছে কিলার আব্বাসের স্ত্রীর ‘হামিদা এন্টারপ্রাইজের’ নামে। গত ফেব্রুয়ারিতে কিলার আব্বাসের পক্ষ থেকে কচুক্ষেতের হাইটেক হাসপাতালে ৫০ লাখ টাকার চাঁদা দাবি করা হয়। এ নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল্লাহ সাদিক কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। একই সময়ে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয় কচুক্ষেত বাজারের আলামিন বেডিং স্টোরের মালিক আবুল কালামের কাছে। চাঁদা দিতে না পারায় আবুল কালামের পায়ে গুলি করেন কিলার আব্বাসের মাঠের সন্ত্রাসী শাহীন শিকদার। কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, কচুক্ষেত ও ভাষানটেক এলাকার সব ডিশ ব্যবসা এখন কিলার আব্বাসের স্ত্রী হামিদার নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের ছেলের নামে নামকরণ করা হয়েছে ‘আইদান কেবল নেটওয়ার্ক’।
ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে ২০১৭ সালে গুলি করা হয় মিজান ডিশ লাইনের ম্যানেজার জালালকে। এই ঘটনায় ব্যবসা রেখে পালিয়ে যান মিজান ও জালাল। গত বছর ডিসেম্বর মাসে আরেক ডিস ব্যবসায়ী কাফরুলের ছাত্রদল নেতা আকতারের হাত-পা ভেঙে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে তাঁর ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয় কিলার আব্বাস।
২০১৬ সালের জুন মাসে বিদেশ থেকে শাহাদতের একটি ফোন কল আসে মিরপুর-১ নম্বরের শাহ জালাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক জুনায়েদ আহমেদের কাছে। দুই কোটি টাকার চাঁদা দাবি করা হয়। তিনি টাকা দিতে পারেননি। শাহাদাতের নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয় জুনায়েদকে। তার আগে ২০০৩ সালে চাঁদা না দেওয়ার কারণে প্রকাশ্য দিবালোকে শাহাদত গুলি করে হত্যা করেন প্রিন্স বাজারের মালিক কাজী শহীদকে।
রূপনগর আবাসিক এলাকায় একটি ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গত বছর শেষের দিকে শাহাদতের চাঁদা দাবির কারণে তিন মাস কাজ বন্ধ রাখতে হয় একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোবাশ্বের আলীকে। পরে চাঁদা পরিশোধ করে কাজ শুরু করতে হয়। রূপনগরের শেয়ালবাড়ী এলাকার বাসিন্দা মিরপুর থানা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক আবদুস সাত্তার মাদক ও চাঁদাবাজমুক্ত মিরপুর গড়ার প্রচার শুরু করার পরই গত ২৪ এপ্রিল তাঁকে গুলি করা হয়। গুলিতে তাঁর একটি কিডনি অকেজো হয়ে গেলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। আবদুস সাত্তার বলেন, ‘জীবন নিয়ে সংশয়ে আছি, কারো নাম বলতে চাই না।’
গত জুলাই মাসে হোয়াটস অ্যাপের পর পর তিনটি নম্বর থেকে রূপনগরের ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানকে ফোন করে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। ১৪ জুলাই কারো নাম উল্লেখ না করে ফোন নম্বর দিয়ে রূপনগর থানায় তিনি সাধারণ ডায়েরি করেন। চলতি মাসে পল্লবীর শীর্ষ সন্ত্রাসী বিদেশে পলাতক মামুন ও জামিল ওই এলাকার ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী ইন্তাজ ও ইউসুফ এবং পাঞ্জাবি বিক্রেতা ইব্রাহিমের কাছে দুই লাখ করে চাঁদা দাবি করেন। স্থানীয় এক কাউন্সিলরের মাধ্যমে এক লাখ করে দিয়ে তাঁরা এ যাত্রায় রক্ষা পান।
মিরপুরের একজন কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ মাসেই তিনি এক সন্ত্রাসীকে পাঁচ লাখ এবং আরেক সন্ত্রাসীকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি টাকা দিইনি, আমার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময়ে আমার স্ত্রীকে ওই সন্ত্রাসীর প্রতিনিধিরা হুমকি দেয়।’
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিদেশে ও কারাগারে অবস্থানকারী ওই ছয় সন্ত্রাসীর সহযোগী ও প্রতিনিধি হিসেবে মিরপুরজুড়ে প্রায় অর্ধশতের বেশি অস্ত্রবাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়া ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কিছু লোক আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেও নেতা হিসেবে রয়েছেন। এঁদের মধ্যে শাহাদতের লোক হিসেবে রয়েছে লাক্কু, হাফিজুর রহমান বাপ্পি, দেলোয়ার প্রধান ও জয়। মামুন ও জামিলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে জামিলের শ্যালক লিংকন, ভগ্নিপতি মুক্তি ও যুবনেতা রওশন। চানের লোক হিসেবে মাঠে সক্রিয় আনোয়ার বুলবুল ও আম্বালা।
মাঠে সবচেয়ে বেশি ক্যাডার কিলার আব্বাসের। তাঁর বাহিনীতে রয়েছে ভাগ্নে ডেভিড, আলাউদ্দিন, শাহীন শিকদার দিলু, রূপনগরের ফরিদ, ৬ নম্বরের জিয়াউল, সেন্টু, শামীম, মোশাররফ ও নূর হোসেন লেদু। ভাসানটেকের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিমের লোকেরা এখন কিলার আব্বাসের বাহিনীতে। ইব্রাহিম বিদেশে থাকলেও চাঁদার ভাগ পান। এ ছাড়া কিলার আব্বাসের নিয়ন্ত্রণে একটি ভাড়াটিয়া কিলার গ্রুপ রয়েছে, যারা সব সন্ত্রাসীর পক্ষেই ভাড়াটিয়া হিসেবে কাজ করে। এরা হচ্ছে ভাসানটেকের রবিন, তপু, আবদুর রহমান, ১৩ নম্বর সেকশনের ভায়রা বাবু ও চামার বাবু, ১০ নম্বরের রহিম, স্বপন আউয়াল ও শাহজাহান।
বিদেশে অবস্থান করা ও কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও বর্তমানে মাঠে। তাদের সন্ত্রাসী এজেন্টদের মাধ্যমে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি কিভাবে করছে জানতে চাইলে মিরপুর জোনের উপপুলিশ কমিশনার আ স ম মাহাতাবউদ্দিন বলেন, ‘আসলে অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ এখনো আসেনি।’ গত ১৪ জুলাই মিজানুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ীর চাঁদাবাজদের হাত থেকে রক্ষা পেতে রূপনগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা প্রসঙ্গটি তুললে তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র কুড়ি দিন হলো মিরপুর জোনে যোগ দিয়েছি। তবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
Posted ২:১১ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৮ আগস্ট ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin