ফরাসি-ব্রিটিশ বায়োপিক ‘দ্য লেডি’তে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির সংগ্রামী জীবন নিজ অভিনয়শৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন মালয়েশীয় অভিনেত্রী মিশেল ইয়োহ। ২০১১ সালের ওই চলচ্চিত্র শেষ হয়েছে সু চির গৃহবন্দিত্বের অবসানের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। মিয়ানমারে অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো সেই সু চির নাম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা জেনোসাইডের সঙ্গেও জড়িয়েছে। জেনোসাইড ও গণহত্যাকারীদের পক্ষ নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলায় নেতৃত্বও দিয়েছেন। সু চির চরিত্রে অভিনয় করা সেই মিশেল ইয়োহ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কক্সবাজারে এসেছিলেন নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের দেখতে। সে সময় তিনি সু চির সাম্প্রতিক বছরগুলোর ভূমিকার নিন্দা জানান।
শুধু অং সান সু চি নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য অনেক বিতর্কিত ও যুদ্ধবাজদের নামও প্রায় প্রতিবছরই নির্বাচক কমিটির কাছে জমা হয়। অনেক সময় তাঁরা পুরস্কারও পেয়ে যান। জার্মানির অ্যাডল্ফ হিটলার, ইতালির বেনিতো মুসোলিনির মতো যুদ্ধবাজদেরও নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার জন্য কেউ না কেউ মনোনয়ন দিয়েছিল। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ, চিলি, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুর ও ভিয়েতনামে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে। সেই কিসিঞ্জারও ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতি ও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে আলোচনার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, বিতর্কের কারণে ৯৭ বছর বয়সেও কিসিঞ্জারকে এখন সতর্কভাবে বিদেশ সফর করতে হয়।
আগামী বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নির্বাচক কমিটির কাছে বেশ আগেই গেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। গত সপ্তাহে বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সইয়ের পর মনোনীতদের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও। এ বছরের শুরুতেই ইরাকে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিচারবহির্ভূত হত্যা বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার অ্যানিয়েস ক্যালেমা ওই হামলাকে ‘বেআইনি’ অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘের এই কর্মকর্তার মতে, ওই হামলা চালানোর জন্য জোরালো আশু ঝুঁকি যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, সোলাইমানিকে হত্যার মাধ্যমে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে বৈরিতা বাড়িয়েছেন। এতে বিশ্ব আরো অনিরাপদ হয়েছে, বেড়েছে সংঘাতের ঝুঁকি। ট্রাম্প প্রশাসন আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের ‘যুদ্ধাপরাধ’ তদন্ত ও বিচার ঠেকাতে আইসিসি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গত নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরাকে মার্কিন এক সেনার যুদ্ধাপরাধ ক্ষমা করেছেন।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও যুদ্ধাপরাধে ইসরায়েলি সেনাদের পাশাপাশি নির্দেশদাতা হিসেবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নাম এসেছে। আইসিসির প্রসিকিউটরের দপ্তর এর তদন্ত করতে গিয়েও পরিস্থিতি ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় ‘পিছু হটেছে’।
এ ধরনের যুদ্ধবাজ ও বিতর্কিতদের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নাম কেউ প্রস্তাব করেছেন, সে জন্য কমিটির কাছে যাচ্ছে। কমিটি কাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে একটি ভালো উদ্দেশ্যে, ইতিবাচক, সৃজনশীল কাজকেই তারা পুরস্কৃত করে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো একটি ঘটনা ঘটলে নাম তো যেতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি, নোবেল কমিটির যাঁরা এর সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা আরো অনেক বেশি সুবিবেচনাসম্পন্ন, বিজ্ঞ মানুষ। তাঁরা সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।’
ইসরায়েলের নেতানিয়াহুকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন ইতালির পার্লামেন্ট সদস্য পাওলো গ্রিমালদি। তিনি গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি নেতানিয়াহুকে মনোনয়ন দিয়েছেন। নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ফল এনেছেন। এটি ভবিষ্যতে শান্তি আনতে পারে। সৌদি আরবসহ আরো দেশ এমন চুক্তি করতে পারে। পাওলো গ্রিমালদি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি একজনের বেশি মনোনয়ন দিতে পারছেন না। ট্রাম্প এরই মধ্যে মনোনীত হয়েছেন। তাই তিনি নেতানিয়াহুকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তাঁর মতে, ট্রাম্প, নেতানিয়াহু—দুজনেরই পুরস্কার পাওয়া উচিত। অতীতে বারাক ওবামা কোনো ফলাফল না এনেই পুরস্কার পেয়েছেন। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু শান্তিচুক্তি করে শান্তির পক্ষে বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ওবামা পেলে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু কেন নয়? তা ছাড়া ইসরায়েল গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ওই অঞ্চলের একমাত্র গণতন্ত্র ইসরায়েলে।
ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো মনোনীত করেছেন নরওয়ের কট্টর ডানপন্থী সংসদ সদস্য ক্রিস্টিয়ান টিবরিং-ইয়েদা। গত ৯ সেপ্টেম্বর তিনি আমেরিকান নিউজ চ্যানেল ফক্স নিউজকে বলেন, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত অন্য ব্যক্তিদের চেয়ে ট্রাম্পের ভূমিকা অনেক বেশি।
এখনো নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার আক্ষেপ আছে ট্রাম্পের। তাই টিবরিং-ইয়েদা যখন তাঁকে নোবেলের জন্য মনোনীত করার কথা টুইট করেছিলেন, তখন ট্রাম্প তাঁকে ধন্যবাদ জানান। তবে ট্রাম্প নিজেই ২০১৩ সালে এক টুইট বার্তায় প্রেসিডেন্ট ওবামার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সমালোচনা করেছিলেন। ‘ডাবল ডাউন : গেম চেঞ্জ ২০১২’ বইয়ের প্রসঙ্গ টেনে ট্রাম্প লিখেছিলেন, “সদ্য প্রকাশিত ডাবল ডাউন বই অনুযায়ী শান্তিতে নোবেল পাওয়া আমাদের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আমি মানুষ হত্যায় খুব দক্ষ।’ অসলো (নরওয়ের রাজধানী) কি পুরস্কার ফিরিয়ে নিতে পারে?”
তবে বাস্তবতা হলো, নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার ইতিহাস অসলোর নোবেল কমিটির নেই। সু চির ১৯৯১ সালের নোবেল পুরস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক আলোচনা-বিতর্ক হলেও এ ক্ষেত্রে নোবেল কমিটির কিছুই করার নেই।
বিগত বছরগুলোতে অনেক সময়ই নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, শান্তি প্রতিষ্ঠার আগেই বা ত্রুটিপূর্ণ সংজ্ঞার মাধ্যমে পুরস্কার নির্ধারণের অভিযোগ উঠেছে। আবার অনেকে অঞ্চলভেদে নন্দিত ও নিন্দিত।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিষয়ক কমিটির তথ্য অনুযায়ী, পুরস্কারের জন্য কে কাকে মনোনয়ন দিচ্ছে সে বিষয়ে তারা কোনো তথ্য দেয় না। তবে পুরস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার ৫০ বছর পর এ বিষয়ে তথ্য দেওয়ার সুযোগ আছে। কোনোভাবে গণমাধ্যমে মনোনীত বা মনোনয়ন প্রদানকারী হিসেবে কারো নাম এলে নোবেল কমিটি তার সত্যতা নিশ্চিত বা প্রত্যাখ্যান—কোনোটাই করে না। কোনো মনোনয়নও চাওয়া হয় না। স্বাধীন-সার্বভৌম যেকোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে আইসিসি, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকসহ আরো অনেক ক্যাটাগরির ব্যক্তিরা পুরস্কারের জন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে এবং কেন পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা উচিত, তা জানাতে পারেন।
২০২০ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রার্থী তালিকায় আছে ৩১৮টি নাম। এর মধ্যে ২১১টি ব্যক্তি ও ১০৭টি সংস্থা। নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্টের নিয়োগ দেওয়া পাঁচ সদস্যের কমিটি ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করছে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করা হবে আগামী ৯ অক্টোবর।
জানা গেছে, প্রতিবছরের পুরস্কারের জন্য কাজ শুরু হয় আগের বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩১ জানুয়ারি রাত ১২টা (সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান টাইম)। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে তৈরি করা হয় মনোনীতদের সংক্ষিপ্ত তালিকা। এরপর আগস্ট পর্যন্ত চলে পর্যালোচনা। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয় অক্টোবরের পূর্ণ সপ্তাহের প্রথম শুক্রবার। নির্বাচনের বিষয়ে কমিটির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কোনো আপিলের সুযোগ নেই।
Posted ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin