২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সৃষ্ট বিশাল এক মানবিক সংকট প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। সহিংস হামলার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসে। তাদের গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তারা সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করলে মানুষের নজিরবিহীন এক ঢলের সৃষ্টি করে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লাখে। এই সংখ্যাটা ক্রমে ক্রমে এখনো বৃদ্ধিও পাচ্ছে।
মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার জেলার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও জীব-বৈচিত্র্য প্রায় ধ্বংসের মুখে। এখন ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। পুরনো দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্প এবং নতুন অনিবন্ধিত ৩২টি ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩৪টি। ৬ হাজার ১৬৪ দশমিক ০২ একর বনভূমি দখল করে এসব ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, ভূমিরূপ পরিবর্তন, জীব-বৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৮ম সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি টাকার অংকে প্রায় ৪৫৭ কোটি টাকা এবং জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি প্রায় ১ হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। মোট ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
এতে আরো বলা হয়, ৫৮০ একর সৃজিত বন এবং এক হাজার ২৫৭ একর প্রাকৃতিক বনসহ ক্যাম্প এলাকার বাইরে জ্বালানি সংগ্রহে রোহিঙ্গারা বনাঞ্চল উজাড় করেছে এক হাজার ৮৩৫ একর। সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ৮ হাজার ১ দশমিক ০২ একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীব-বৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, একটি গুইসাপ, শিয়াল অথবা একটি পেঁচা বছরে পরিবেশগত যে সেবা দিয়ে থাকে তার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা। মাত্র ১০ বছর বয়সী একটি তেঁতুল গাছ যে অক্সিজেন উৎপাদন করে তা ১৫০ জন মানুষের জন্য যথেষ্ট। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় নিম গাছ হলো পলিউশন ক্লিনার, যা দূষিত বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প তৈরি করতে গিয়ে ৮ হাজার একর বনাঞ্চলের এই ধরনের হাজার হাজার বৃক্ষ ধ্বংস হয়েছে, বিভিন্ন প্রাণিকুল হারিয়ে গেছে। আর হারিয়ে যাওয়া কয়েকশত প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে যদি গুইসাপের মতো কেবল একটি প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা একর প্রতি একটা করে ৮ হাজারও ধরা হয় তাহলে বছরে পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ‘মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এক সময় হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়তো গাছও লাগানো যাবে কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না। অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে তো আর পাহাড়ের কাটা জায়গা পূরণ করা যাবে না। এই পাহাড়গুলো ১৫-২০ মিলিয়ন বছরের (দেড় থেকে দুই কোটি বছর) পুরনো। পাহাড়গুলো কাটার ফলে এখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মধ্যে পানি ঢুকে পড়বে। এতে যেকোনো সময় পাহাড় ধসে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। আর যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের এই ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।
এদিকে, এক গবেষণায় মিলেছে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে এ পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি টিউবওয়েল স্থাপন করতে হয়েছে। এ কারণে পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নামছে। ওই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত পানির ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। এ জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের পাশাপাশি পরবর্তী ক্ষতি রোধের উপায় ও কতটুকু ক্ষতি পুষিয়ে আনা যাবে এবং এ উদ্দেশ্যে কী করণীয় সে সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, একটি গাছ তার শেকড়ের সঙ্গে পানি ধরে রাখে। এর কারণে ভূ-পৃষ্ঠের পানির স্তর উপরের দিকে থাকে। যখন গাছটি মরে যায় বা যেখানে গাছ থাকে না সেখানে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। কক্সবাজারে অতিরিক্ত টিউবওয়েলের কারণে যেমন পানির স্তর নিচে নামছে, বন উজাড়ের কারণেও স্তর নেমে যাচ্ছে। এটা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে একটা গবেষণা করেছি। তাতে দেখা গেছে, যখন ব্যাপক হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসতে শুরু করে তখন প্রথম তিন মাসেই কক্সবাজারের বনাঞ্চলের ১১ ভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে একদিকে যেমন মানুষ বেড়েছে তার সঙ্গে তাদের নিঃসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও বেড়েছে। অপরদিকে গাছ কাটার মাধ্যমে কার্বন শোষণের ‘প্রাকৃতিক মেশিন’ বন্ধ হয়ে গেছে। দুই দিক থেকেই ক্ষতি হয়েছে। এখন দ্বিগুণ হারে সেখানে কার্বন জমছে।
রোহিঙ্গাদের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় বন্যপ্রাণীরাও। বিশেষ করে বিপদে পড়েছে হাতি। বন বিভাগ জানিয়েছে, কক্সবাজারের বনাঞ্চলে ৬৩টি হাতি রয়েছে। এসব হাতির চলাচলের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে ৩টি করিডোর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে তুলা বাগান-পানেরছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল ও উখিয়া-ঘুমধুম। রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের কারণে এরই মধ্যে উখিয়া-ঘুমধুম করিডোরটি বন্ধ হয়ে গেছে। এ এলাকায় হাতি-মানুষ সংঘাতে এ পর্যন্ত ১২ জন মানুষ মারা গেছে। বাকি দুটি করিডোরও প্রায় বন্ধের মুখে।
এদিকে, জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে স্রোতের মতো আসা রোহিঙ্গাদের কারণে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যয়, পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়েছে।
কক্সবাজারের প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারে সাড়ে ৩০০ হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজ রয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের অনেককেই হোটেল-মোটেলে দেহ ব্যবসায় পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে এইডস আক্রান্তরাও রয়েছেন। তাদের সঙ্গে পর্যটকসহ হোটেল-মোটেল শ্রমিকদের শারীরিক মেলামেশায় বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অনেকে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ায় দেশে এইডস ছড়ানোর আশঙ্কা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় রোহিঙ্গাদের অনেকেই পালিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের কাছেও তারা আশ্রয় নিচ্ছেন। পুরনো রোহিঙ্গারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে নানা রকম অবৈধ ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ।
অভাব অনটনে পড়া রোহিঙ্গা নারীরা যদি কক্সবাজারে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অনেকেই সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। দেশের মানুষও পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে অনাগ্রহ দেখাবেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। এখনই রোহিঙ্গা নারীদের কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা করতে দেখেছেন অনেকে। দেহ ব্যবসায়ও অনেক নারীকে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন প্রশাসনও। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারকে অনেকেই পাশ কাটিয়ে অন্য পর্যটনকেন্দ্রে চলে যেতে পারেন। এমনটা হলে কক্সবাজারের পর্যটনে ভয়াবহ ধস নামতে পারে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়, সেজন্য সেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বেড়েছে। আর এই ব্যয়টা খরচ হচ্ছে বাজেট থেকে। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যার বদলে এই খরচটা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত।
সরেজমিনে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং নিজ ভিটে-বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি পূরণ করে মিয়ানমারে ফিরতে চান বলে মত দিয়েছেন।
রোহিঙ্গারা বলছেন- তারা বাংলাদেশে আর থাকতে চান না। যত দ্রুত সম্ভব তারা তাদের নিজ দেশে ফিরতে চান কিন্তু মিয়ানমার সরকার গড়িমসি করছে বলেই প্রত্যাবাসন ঝুলে রয়েছে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী কমিউনিটির সহ-সভাপতি মাস্টার আব্দুর রহিম ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, আমরা সব সময়ই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। যখন সুযোগ হবে তখনই ফিরে যাব কিন্তু তার আগে আমাদের সেখানে নিরাপত্তা, বাসস্থান, নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এই নিশ্চয়তা কে দেবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটার নিশ্চয়তা মিয়ানমার সরকারকে দিতে হবে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের একার মাথাব্যথা নয়। গোটা বিশ্বের দায় রয়েছে এই সমস্যা সমাধান করার। আর রোহিঙ্গাদের তাদের অধিকারসহ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোটাই সংকটের একমাত্র সমাধান। এই সমাধান যত দ্রুত মিলবে ততই মঙ্গল।
Posted ৩:০৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin