২৭ দিন আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন আশুলিয়ার সাভার রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মিন্টু চন্দ্র বর্মণ (৩৬)। তাঁকে হত্যার পর খুনিরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মাঠে শহীদ মিনারের সামনে দেয়ালের পাশে গর্ত করে পুঁতে রাখে মরদেহের পাঁচটি টুকরা। গতকাল সোমবার সকালে মাটি খুঁড়ে ওই টুকরাগুলো উদ্ধার করেছেন র্যাব-৪-এর সদস্যরা।
খুনিরা অধ্যক্ষের মরদেহ থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দিয়েছিল রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায়; যা উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে র্যাব। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
র্যাব-৪-এর আশুলিয়ার নবীনগর ক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রাকিব মাহমুদ খান জানান, গত ১৩ জুলাই আশুলিয়ার জামগড়াসংলগ্ন বেরন এলাকার রূপায়ণ মাঠের নিজ বাসা ‘স্বপ্ন নিবাস’ থেকে স্কুলে যাওয়ার পর নিখোঁজ হন মিন্টু চন্দ্র বর্মণ। এর পর থেকে তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। সাত দিন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে সন্ধান না পেয়ে অবশেষে ২২ জুলাই আশুলিয়া থানায় নিখোঁজের ডায়েরি করেন মিন্টুর ছোট ভাই দীপক চন্দ্র বর্মণ। পরে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে একই প্রতিষ্ঠানের দুই শিক্ষকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে মরদেহের লোকেশন শনাক্ত করে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রবিউল ইসলাম, শিক্ষক মোতালেব ও রবিউলের ভাগ্নে রহিম বাদশাকে। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানের মাঠের মধ্যে পুঁতে রাখা দেহের খণ্ডিত অংশ পাওয়া যায়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যাঁদের আটক করা হয়েছে তাঁদের ভাষ্য মতে, স্কুলের শ্রেণিকক্ষেই মিন্টু বর্মণকে কুপিয়ে খুন করা হয়। পরে মরদেহ ছয় টুকরা করে পাঁচ টুকরা স্কুলের মাঠেই পুঁতে ফেলা হয়। এরপর বিচ্ছিন্ন মাথা ফেলা হয় রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায়।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারে, প্রথমে ৭ জুলাই মিন্টুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রবিউল, মোতালেব ও বাদশা। পরে ১৩ জুলাই রাতে স্কুলটিতে কোচিং-পরবর্তী সময়ে ১০৬ নম্বর কক্ষে মিন্টুকে ডেকে নিয়ে যান বাদশা ও মোতালেব। এ সময় মিন্টুর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেন বাদশা। পরে তাঁর দেহ ছয় টুকরা করে মাথা রাজধানীর আশকোনার একটি ডোবায় ফেলে দেন। বাকি পাঁচ টুকরা স্কুলের মাঠে পুঁতে রাখেন। কলেজের ভেতরের সিঁড়ির নিচ থেকে হত্যা ও গুমে ব্যবহার করা দা, হাতুড়ি, শাবল এবং আসামিদের রক্তমাখা পোশাক জব্দ করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
অধ্যক্ষ মিন্টু চন্দ্র বর্মণ (৩৬) লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার টংভাঙ্গা ইউনিয়নের বাড়াইপাড়া গ্রামের শরত বর্মণের সন্তান। তিনি মোতালেব, শামসুজ্জামান ও রবিউল ইসলাম নামের তিন ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে দুই বছর আগে আশুলিয়ার জামগড়ার অদূরে বেরন এলাকার জাহিদুল ইসলামের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সাভার রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর থেকে পাশের স্বপ্ন নিবাসে ভাড়া থেকে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
অনেক বছর বাড়ি যাননি মিন্টু
এদিকে লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, মিন্টু চন্দ্র বর্মণের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বাড়াইপাড়া গ্রামে শুরু হয় কান্না আর শোকের মাতম। পরিবার-স্বজনের সেই শোক যেন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো উপজেলায়। বিকেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, কর্দমাক্ত উঠানে বিরামহীনভাবে গড়াগড়ি দিচ্ছেন মিন্টুর ছোট ভাই অনুকূল বর্মণ। স্বজনরা কিছুতেই তাঁকে সামলাতে পারছেন না। অনেক চেষ্টার পরেও কথা বলা সম্ভব হয়নি তাঁর সঙ্গে। মা ত্রিবেণী বালা ঘরের মেঝেতেও ডুকরে কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন, ‘মোর বাবা কী অপরাধ করছে যে ওমরা (খুনিরা) মোর (আমার) বাবাক টুকরা টুকরা করছে? মুই বিচার চাং (চাই)।’ শুধু অনুকূল ও তাঁর মা-ই নন, কাঁদতে কাঁদতে যেন নির্বাক হয়েছেন বৃদ্ধ বাবা শরৎ বর্মণ। কাঁদছেন স্বজন-প্রতিবেশীরাও।
পরিবারের লোকজন জানায়, কৃষক শরৎ চন্দ্রের পাঁচ ছেলের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মিন্টু চন্দ্র বর্মণ। স্থানীয় বিদ্যালয় ও কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেন রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে। গত ঈদের সময় বাড়িতে আসার কথা ছিল তাঁর। সে সময় তাঁকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেছিল পরিবার। কিন্তু ঈদের কয়েক দিন আগেই তিনি নিখোঁজ হন।
নিহতের বাবা শরৎ চন্দ্র জানান, প্রায় আট বিঘা আবাদি জমি বিক্রি করে বিভিন্ন সময়ে টাকা দিয়েছিলেন মিন্টুকে। টাকা দিয়েও সরকারি চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত সাভার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের জন্য বেশ কয়েক লাখ টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। আবাদি জমির প্রায় সবটুকু বিক্রি করায় এখন তাঁদের সংসারেও টান পড়েছে।
কাকাতো বোন অঞ্জলি রানী বলেন, ‘মিন্টু সরকারি চাকরির জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে। পরে বিদেশেও গিয়েছিল; কিন্তু জাল ভিসার কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। পরে সাভারে কলেজের প্রিন্সিপাল হয়। বাবার সব জমি বিক্রির টাকা নষ্ট করায় সে অনেক বছর ধরে বাড়ি আসেনি। বলেছিল অনেক টাকা ইনকাম করতে পারলে তখনই বাড়ি ফিরবে। তবে ফোনে সবার সঙ্গে কথা বলেছিল।’ শরৎ চন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘টাকার কারণেই আমার ছেলে অনেক বছর ধরে বাড়ি আসেনি। বছরখানেক আগে পাশের দইখাওয়া হাটে এসে আমার সাথে দেখা করে সেখান থেকেই ফিরে গেছে। আর কোনো দিন বাড়ি আসবে না আমার ছেলে।’
মরদেহ নিতে সাভারে যাওয়া ছোট ভাই দীপক চন্দ্র বর্মণ ফোনে জানান, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হবে।
Posted ২:৫৩ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin