স্ত্রী, ভাই, ভগ্নিপতি এবং ভাতিজাসহ সাত স্বজনকে নিয়ে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র গড়ে তুলেছিলেন মানিকগঞ্জের জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু। প্রথমে পারিবারিকভাবে চক্র গড়ে তুললেও পরীক্ষার্থী জোগাড় ও তাদের কাছে প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য চক্রের সদস্য সংগ্রহ করা হয় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে।
জসিমের অন্যতম সহযোগী তার খালাতো ভাই আবদুস সালাম খান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেসের মেশিনম্যান। প্রেসে ছাপানোর সময়ই তিনি প্রশ্নপত্র বিশেষ কৌশলে বের করে এনে তুলে দিতেন এই চক্রের মূল হোতা জসিমের হাতে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে চক্রটি। শত শত মেডিকেল শিক্ষার্থী ফাঁস করা প্রশ্নপত্র নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে।
প্রশ্নপত্র বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন জসিম ও তার সহযোগীরা। ঢাকার মিরপুরে জসিমের দুটি ছয়তলা বাড়িসহ অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, জসিম ও তার চক্রের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তারা অবৈধভাবে সম্পদ গড়ে থাকলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হবে। সে মামলায় সরকারের অনুকূলে সম্পদ বাজেয়াপ্তের আবেদন করবে সিআইডি। জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নুর প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রে ছিলেন স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন ওরফে শিল্পী, ছোট বোনের স্বামী জাকির হোসেন দিপু, বড় বোনের স্বামী আলমগীর হোসেন, ভাতিজা পারভেজ খান, ভায়রাভাই সামিউল জাফর ওরফে সেটু এবং খালাতো ভাই আবদুস সালাম খান। সালাম মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নপত্র প্রেস থেকে এনে দিলে জসিম অন্যান্য সদস্যের মাধ্যমে সারাদেশের পরীক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করতেন। আবদুস সালামের প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে অধিদপ্তরের ক্ষমতাবান কর্তাদেরও মদদ ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেসের ম্যানেজার ফাইজুর রহমান বলেন, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়। পুরো প্রেস সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকে। ছাপানোর সময় মেশিনম্যান আবদুস সালাম খানসহ তার আরেক সহকারী থাকতেন প্রেস মেশিনে। এ ছাড়া ছাপাখানায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্যরাও থাকতেন। তিনি বলেন, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের গ্রামের বাড়ি এলাকার একটি হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় তাকে কয়েক বছর আগে সাসপেন্ড করা হয়েছে।
গত ১৯ ও ২০ জুলাই রাজধানীর মিরপুর থেকে চক্রের মূল হোতা জসিমসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গ্রেপ্তার অপর চারজন হলেন- সানোয়ার হোসেন, মোহাইমিনুল ওরফে বাঁধন এবং জসিমের ছোট বোনের স্বামী জাকির হোসেন দিপু ও ভাতিজা পারভেজ খান। জসিমের কাছ থেকে দুই কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, দুই কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক এবং পারভেজের কাছ থেকে ৮৪ লাখ টাকার চেক উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার পাঁচজনসহ পলাতক নয়জনের বিরুদ্ধে ২০ জুলাই মিরপুর থানায় মামলা করেছে সিআইডি। জসিম, পারভেজ ও জাকিরকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি। প্রেসম্যান আবদুস সালাম ও জসিমের স্ত্রী শিল্পীসহ পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সিআইডির অভিযান অব্যাহত আছে।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। জসিম এর আগের দিন রাতে চক্রের সদস্য সানোয়ারকে মিরপুর ২ নম্বরের প্রশিকার মোড়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ করেন। এই প্রশ্ন জসিম সংগ্রহ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেসের মেশিনম্যান সালামের কাছ থেকে। জসিমের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেয়ে সানোয়ার মোবাইল ফোনে সেটির ছবি তুলে অন্য সদস্যদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেন। পরীক্ষার্থীদের কাছে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন তারা। ২০১৪ সালেও তারা ৪০-৫০ শিক্ষার্থীর কাছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেন। ২০১৫ সালেও একইভাবে জসিম সালামের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। পরীক্ষা শুরুর আগে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সানোয়ার ও জাকির হোসেন ওরফে দিপুসহ চক্রের অপর সদস্যরা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের ভোটার আইডি কার্ড, প্রবেশপত্রের ফটোকপি, যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করে জসিমের মিরপুরের বাসায় দিয়ে আসেন। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা নগদ টাকা এবং চেকও পৌঁছে দেওয়া হয় জসিমকে। পরীক্ষার আগের দিন রাতে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র সামিউল জাফর ওরফে সিটু জসিমের স্ত্রী শিল্পীকে পৌঁছে দেন। শিল্পী পরে অপর সদস্যদের কাছে তা সরবরাহ করেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় একইভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এই চক্র।
এজাহারভুক্ত ১৪ আসামি :গত ২০ জুলাই মিরপুর থানায় সিআইডি বাদী হয়ে প্রশ্নফাঁস চক্রের মূল হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নুসহ ১৪ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ ছাড়া ১৫০-২০০ জন অজ্ঞাতপরিচয়কে আসামি করা হয়েছে। জসিমের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার খানবাড়িয়া এলাকায়। তবে তিনি বসবাস করেন রাজধানীর মিরপুরে। এজাহারভুক্ত অপর আসামিরা হলেন- শারমিন আরা জেসমিন ওরফে শিল্পী, জাকির হোসেন দিপু, আলমগীর হোসেন, পারভেজ খান, সামিউল জাফর ওরফে সেটু, আবদুস সালাম খান, তুরাগের এস এম সানোয়ার হোসেন, নোয়াখালীর চাটখিলের নারায়ণপুরের বাসিন্দা ডা. জেডএমএ সালেহীন ওরফে শোভন, সাভার চাকুরিয়ার আক্তারুজ্জামান খান ওরফে তুষার, শরীয়তপুরের পালং থানার চরযাদবপুরের রাশেদ খান মেনন, নাটোরের মোহাইমেনুল ইসলাম বাঁধন এবং রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ডা. মুহাম্মদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থীকেও আসামি করা হয়েছে।
Posted ৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৫ জুলাই ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin