বরাবরের মতো এ বছরও ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পূর্বনাম ছিল আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতিবছর নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’।
এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারী দিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য এক-এক প্রকার হয়। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে এ দিবসকে নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়।
বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়, বাংলাদেশে এই দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি না হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত উদ্যোগে নারীদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্ড প্রোগ্রাম এবং গিফটের প্রচলন করে আসছে বেশকিছু বছর ধরে, এই দিনে নারীদের নিয়ে বিভিন্ন টকশো, লাইভ শো এবং রিকগনিশন অ্যাওয়ার্ড আয়োজন করা হয়ে থাকে, নারীরা বেগুনি রঙের শাড়িতে সজ্জিত হয়ে দিনটিকে সেলিব্রিটি করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে নারী দিবস পালনের সার্থকতা তখনি হবে যখন নারী পাবে তার সঠিক অবস্থান, অধিকার এবং মর্যাদা, সেটা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সর্বস্তরে। অধিকারের জন্য যুগে যুগে চলছে নারীদের এক নীরব লড়াই। কখনও পারিবারিকভাবে কখনও সামাজিকভাবে এ লড়াইয়ের যেন আর শেষ নেই।
নারী সচেতনতা এবং নারীর প্রতি পারিবারিক এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে পারে নারীদের অবস্থার পরিবর্তন। আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে জন্ম হওয়ার পর থেকে শুরু হয়ে যায় নারী-পুরুষের বিভাজনের এক খেলা। যেখানে জন্ম হওয়ার পর থেকেই একটি মেয়ে দেখে বড় হয় তার থেকে তার ভাইকে পারিবারিকভাবে বেশি মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে তখন একটা সময়ের পর থেকে তার কাছে এটাই স্বাভাবিক মনে হয়।
আবার যখন একটা ছেলে সন্তান এটা দেখে বড় হয় সব দিক থেকে সে তার বোনের থেকে পারিবারিকভাবে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে তখন তার কাছে মনে হয় এটা অতি সাধারণ ব্যাপার, এটাই তার প্রাপ্য। তার বাবাকে দেখে মাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে তখন সেই ছেলে শিশুটি ছোটবেলা থেকেই নিজের অজান্তেই শিখে যায় কীভাবে বোনকে প্রভাবিত করতে হয়, একটা সময় বড় হয়ে সে তার স্ত্রীকে সেভাবেই প্রভাবিত করে। অফিসের মেয়ে সহকর্মীদের প্রভাবিত করে এবং তার কাছে বিষয়গুলো মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয় না, কারণ এটাতেই সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সেই ছেলেটি আবার যখন কোনো মেয়ে বসের তত্ত্বাবধানে কাজ করে তখন সেই বসের নির্দেশনা কখনোই সহজভাবে নিতে পারে না, এক ধরনের আত্মমর্যাদাবোধ কাজ করে।
নারীদের প্রতি শারীরিক আর মানসিক নির্যাতনের পেছনে অনেক সময়ে দেখা যায়, পুরুষের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে নারীরাও দায়ী। আমাদের অনেক পরিবারে সচারচর দেখা যায় বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ, কেউ কাউকে মেনে নিতে পারে না। দেখা যায়, শাশুড়ি করে বউয়ের ওপর অত্যাচার, আবার বউ করে শাশুড়ির সঙ্গে অত্যাচার। এর জন্যও অনেকটা দায়ী সামাজিক এবং পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ ওই অত্যাচারী শাশুড়ি কোনো একসময়ে তার শাশুড়ির দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল, তাই বউকে নির্যাতন করা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। যেখানে মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার কারণে ছেলের মাকে অভিযোগ দিলে ভালোভাবে গ্রহণ না করে বলে ‘আপনার মেয়েকে ঘরে আটকে রাখেন’ সেখানে নারীর অধিকার আর মর্যাদার বিষয়টি কতটুকু প্রাধান্য পাবে সেটি ভাববার বিষয়।
একটি ছেলে তখনি বড় মনের অধিকারী হয় যখন একটি মেয়েকে সম্মান করবে। যখন সে দেখবে তার পরিবারে একজন নারীকে সম্মান করছে। নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন, পোশাক নিয়ে কটু কথা, কর্মক্ষেত্রে অনাগ্রাধিকার, নারীদের দুর্বল মনে করা, পারিবারিক ও সামাজিক অবমূল্যায়ন এসব রোধে প্রয়োজন পিতা-মাতার সুশিক্ষা, কাউন্সেলিং এবং প্যারেন্টিং ট্রেনিং। যেখানে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য আমরা শিক্ষিত হতে চাই, ভালো চাকরির জন্য বড় বড় ডিগ্রি নেই সেখানে সবচেয়ে সেনসেটিভ একটা জায়গা পরিবার, সেটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য আমরা যথাপোযুক্ত কোনো উদ্বেগই নেই না।
গোড়ায় পানি না ঢেলে আগায় পানি ঢেলে কোনো লাভ হবে না। তাই আমরা যত সভা-সেমিনার করি না কেন, যত সুন্দরভাবে নারী দিবস উদযাপন করি না কেন এসব বিষয়ে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জোরদার কর্মসূচি ও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একজন ভালো মা-বাবা তৈরি করতে আগামীর ভবিষ্যতের সুসন্তান। তাই বন্ধ হোক নারী-পুরুষের ভেদাভেদ, মানুষ আমরা সবাই সমান, মূল্যায়ন করা হোক সবাইকে মনুষ্যত্ব ও মেধা দিয়ে, জেন্ডার দিয়ে নয়। আমরা নারী আমরাও পারি ঘর সংসার সামলে কর্মক্ষেত্রে নিজের অবস্থান গড়তে। চাই না মোরা অগ্রাধিকার, দাও মোদের যতটুকু আমাদের আছে অধিকার।
আসুন সবাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সুরে সুর মিলিয়ে বলি সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী
অর্ধেক তার নর।
লেখক: হেড অব এইচআর, স্টার সিনেপ্লেক্স
Posted ৪:০৭ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৮ মার্চ ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin