আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে এক দশক ধরে আতিথ্য দিয়ে বা লুকিয়ে রেখেছিল পাকিস্তান। এরপর ওসামাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সেই ঘটনার পর এতদিন চলে গেলেও পাকিস্তান এখনও নিশ্চিত না যে লাদের ‘শহীদ’ না আন্তর্জাতিক চিহ্নিত ‘জঙ্গি’।
বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে যখন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ওসামা বিন লাদেনকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি যে তাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘ভুলভাবে’ তুলে ধরা হয়েছে। কোরেশি নিজের ‘বস’ ইমরান খানের পক্ষে সাফাই গাইলেও বিন লাদেনকে নিজে ‘জঙ্গি’ বা সন্ত্রাসী হিসেবে বলেননি। মি. কোরেশি নিজেকে খুব স্মার্ট মনে করেন। কিন্তু বিষয়টি তিনি বেশ গুলিয়ে ফেলেছিলেন, যখন তাঁর কণ্ঠে এটা শোনা গেল, ‘আমি এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।’
কিন্তু পাকিস্তান সরকার এখন দেশের ভেতর যেমন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলের আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছেন তাদের অবস্থান নিয়ে দেশের বাইরেও তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। পাকিস্তানের সরকারের এই অবস্থান নিয়ে দেশটির ভেতরের রক্ষণশীলেরা বেশ খুশি। তবে পাকিস্তানের বাইরের বিশ্বের এখন প্রশ্ন, তাদের রাষ্ট্র পরিচালকেরা যখন বিষয়টি নিয়ে একেকজন একেকরকম কথা বলেন তখন পাকিস্তানের আসল অবস্থানটি কী।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডন গত ২২ জুন তাদের এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, ‘ওসামা বিন লাদেনের মতো একজন যুদ্ধবাজ সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় পাকিস্তানের শীষ নেতৃত্বকে পরিপূর্ণভাবে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে।’ পত্রিকাটি লিখেছে, ‘মি. কোরেশি এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, পাকিস্তান আল কায়েদার প্রয়াত এই নেতাকে সন্ত্রাসী বলে মনে করে। কিন্তু তার ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্য বিশ্বকে ভুল বার্তা দিল।’
আসুন এবার ওসামা বিন লাদেনের শেষ পরিণতির ঘটনা একটু স্মরণ করি। ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের সেনা গ্যারিসন শহর অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে লাদেনকে খুঁজে বের করা হয় এবং ওই অভিযানে লাদেন নিহত হন। কীভাবে, কেন এবং কতদিন ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের খুব পরিচিত একটি এলাকায় এতদিন ধরে থাকতে পেরেছিলেন এর কোনো চূড়ান্ত ফয়সালা আজও হলো না। পাকিস্তানের বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলোর জ্ঞাতসারে বা সহযোগিতায় নাকি তাদের অজ্ঞাতেই লাদেনের এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন- এর উত্তর এখনো অজানা।
ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে সারা বিশ্বের উদ্বেগের বিষয়টি সংবাদপত্রটি উল্লেখ করেছে। তবে বিশ্বের কেউ উদ্বেগ ও ভীতির কথাগুলো ছাড়া কাজের কাজ কিছু করেনি। ডন-এর সেই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘‘পাকিস্তানের বহু জঙ্গির আদর্শিক বা তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে বা নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাতে এদের একটুও বিবেকে বাধে না। এ ব্যাপারে খুব কম লোকই দ্বিমত পোষণ করবেন যে, বিন লাদেন সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় জঙ্গি। তার আদর্শ এবং কৌশল সারাবিশ্বের জঙ্গিদের অনুপ্রেরণার উৎস। তাই ওসামা বিন লাদেনের মতো জঙ্গি সম্পর্কে আমাদের সরকার যখন সারাবিশ্বকে কিছু বলবে তখন তার মধ্যে ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’র মতো শব্দ থাকা যাবে না।’’
পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলোর যদি আমরা মূল্যায়ন করি তাহলে দেখব, খুব বেশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ডন যেভাবে লিখেছে তাও লেখে না। আর জঙ্গিবাদ প্রশ্নে দেশটির বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও নীরব। এই নীরবতা শুধু ওসামা বিন লাদেনের ক্ষেত্রেই না। পাকিস্তানের গণমাধ্যম এখন খুব সরব লাহোরের জোহার টাউন এলাকা এ সপ্তাহে বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশের সক্রিয় কর্মকাণ্ড নিয়ে। ওই বিস্ফোরণে তিনজন নিহত হয়। রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেলিব্রেটিরা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটা রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নয় বা এটি জনবহুল স্থানও নয়। পাকিস্তানে যেখানে জাতিগত দাঙ্গায় বহু মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা এক নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেই তুলনায় লাহোরের এই বিস্ফোরণে হতাহতের সংখ্যা অনেক কমই বলা যায়।
কিন্তু এই বিস্ফোরণকে ঘিরে সহানুভূতির যে ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছে তার নেপথ্য কারণ হলো, বিস্ফোরণটি ঘটেছে জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার প্রতিষ্ঠাতা এবং ঘোষিত জঙ্গি হাফিজ সাঈদের বাড়ির কাছে। অর্থ পাচার এবং জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে অর্থ সহায়তার অভিযোগে সাঈদ এখন জেলে আছেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোরেশিকে প্রশ্নটি করেছিলেন আফগানিস্তানের গণমাধ্যম ‘তোলো’ নিউজের এক নির্ভীক সাংবাদিক। এই প্রশ্নটি এমন সময় উত্থাপিত হলো যখন কাবুল সরকার তালেবান জঙ্গিদের চরম চাপের মধ্যে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী যখন আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে- সে সময় তালেবানরা দেশটির বিস্তৃত এলাকা একের পর এক দখল করে নিচ্ছে।
আফগানিস্তান দীর্ঘ সময় ধরে অভিযোগ করে আসছে, তাদের দেশে তালেবান হামলায় পৃষ্ঠপোষকতা করছে পাকিস্তান। যদিও ইসলামাবাদ বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে এই বলে যে, তালেবান সমস্যা আফগানিস্তানের ‘নিজেদের দ্বন্দ্ব’ বা সমস্যা। ইমরান খান আর কোরেশির আপাত সফল কূটনীতি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ওসামা বিন লাদেনকে ‘শহীদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর যে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়েছে তা আশ্চর্যজনক কিছু না। লাদেন নিয়ে তাদের দ্বৈত ভূমিকা বরাবরই দেখা গেছে। এর আগে তালেবান সমস্যা আফগানিস্তানের ‘নিজেদের দ্বন্দ্ব’ বলে আখ্যায়িত করে তাদের খুঁজে বের করতে দূরত্বের অজুহাত দেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভূমিকায় সেটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। আফগানিস্তান থেকে বিদেশি বাহিনীর প্রত্যাহারের বিষয়েও তাদের আগ্রহ এর প্রমাণ দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের একেবারে সাম্প্রতিক অবস্থানেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইমরান খানের বক্তব্যকে একটু স্মরণ করি। ইমরান বলেছেন, ‘আমেরিকানরা যখন অ্যাবোটাবাদে এলো এবং ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে শহীদ করলো তখন আমরা পাকিস্তানিরা যে কতটা বিব্রত হয়েছিলাম সেটা আমি কখনই ভুলব না।’
ইমরান ‘শহীদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আরবি এই শব্দের অর্থ যিনি ইসলাম ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। পাকিস্তান তালেবানদের সমর্থন করছে কী করছে না সেটা বড় প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, এ সমস্যা আবারও একটি সামরিক সমাধানের দিকে যাচ্ছে। পাকিস্তানের উদ্বেগটা সেখানেই। পাকিস্তান তাদের দ্বৈত অবস্থানের জন্য তালেবানদের সামরিক সহায়তা দেওয়ার কথা অস্বীকার করছে, সেই সঙ্গে এমন পরিস্থিতিতে আনন্দে ডগমগ করছে। বিড়াল দুধ খাওয়ার পর যেভাবে জিব চাটে তাদের অবস্থাটা এখন তেমন।
লাদেনকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সেই সময়টা বেশ অদ্ভূত হলেও সমগ্র বিষয়টি বোঝার জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবেশী আফগানিস্তানে এখন চলছে বহুজাতিক বাহিনীর চলে যাওয়ার তোরজোড়। আর এমন এক সময়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থের উৎস নিয়ে চলছে তোড়জোর। জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর জোট ফিনানসিয়াল টাস্ক ফোর্সের সভাও চলছে। যে জোটটি জঙ্গি অর্থায়নে পাকিস্তানের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে।
এমন এক সময়ে লাদেনকে নিয়ে বিতর্ক প্রশমিত করার বিপরীতে বরং পাকিস্তান সরকার বিষয়টি আরও উসকে দিচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর অন্য সদস্যদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে বিষয়টি নিয়ে কতটা খুশি তারা। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তারা রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে চাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন লেখক জাহিদ হোসেন। ইমরান খান ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোরেশির তীব্র সমালোচক হিসিবে পরিচিত তিনি। মূলত এই
অঞ্চলে জঙ্গিবাদের সমর্থনে ইমরান ও কোরেশির কূটনীতির তীব্র বিরোধিতা করেন তিনি। ওসামা বিন লাদেনের সমালোচনা করতে আপত্তি তাদের এই কূটনীতির একটি নমুনা মাত্র। বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেচনায় রাখা উচিত, কীভাবে পাকিস্তান জঙ্গিদের সর্বদা নিজেদের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে।
জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক দূত আবিদা হুসেন পাকিস্তানের বেসরকারি টিভি চ্যানেল জিও টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওসামা বিন লাদের পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সমর্থন ও আর্থিক সহায়তা দিতেন। নওয়াজ শরিফ এখন বিদেশে নির্বাসনে আছেন।
আবিদা হুসেন বিষয়টি যে জানবেন তা ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ তিনি নওয়াজ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
লাদেনকে ইমরান খান যে ‘শহীদ’ আখ্যা দিলেন এ ঘটনায় অতীতের অনেক কথাই মনে করিয়ে দেয়। এর ঐতিহাসিক এক ভিত্তি রয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ইমরান খানকে ‘তালেবান খান’ হিসেবে অ্যাখায়িত করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই মোশাররফ পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালে তালেবানদের কাবুল থেকে হটিয়ে দেওয়ায় লাদেন পাকিস্তানের আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় এসে ঘাঁটি করে। পরে এক পর্যায়ে অ্যাবোটাবাদে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থাও হয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে।
Posted ১২:৩৮ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৭ জুলাই ২০২১
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin