ডক্টর আবু জাফর সিদ্দিকী
চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জনের দিন ও উৎসবের দিন এ মাসের ১৬ তারিখ। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বিশ্বে আপন পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের বর্বর হানাদারদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল সারা দেশ।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পেয়েছিল তার বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা; পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছিল প্রিয় স্বদেশ। বিজয়ের মাসে আমরা স্মরণ করছি সেসব শহীদকে, যাঁরা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এই লাল-সবুজের পতাকা দিয়েছেন। স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদকে, যাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। স্মরণ করছি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই মুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করে নিতে হয়েছিল।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। শুরু করেছিল নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয় সারাদেশ। কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস-নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যার যা ছিল তাই নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। প্রতিরোধযুদ্ধ রূপ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান বিজয়। বাঙালী জাতিকে একাত্তর সালে শুধু সশস্ত্র পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর বিরম্নদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়নি। যুদ্ধ করতে হয়েছে পাকিসত্মানীদের দোসর এ দেশীয় আলবদর, আলশামস, রাজাকারের বিরুদ্ধে। বাঙালি রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বীর বাঙালি। অনভ্যস্ত হাতেই তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। সম্মুখসমরে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর। পঁচিশে মার্চ ভয়াল রাত্রিতে শুরু হওয়া পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞ আর নৃশংসতার দীর্ঘ ৯টি মাসে রক্তস্নাত পথ পাড়ি দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর চার-পাঁচ লাখ নির্যাতিতা মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিলো অমূল্য এই স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলো বীর বাঙালি। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হয়েছিলো মঞ্চ। পাশের ঢাকা ক্লাব থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আনা হয়েছিলো একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জোন-বি এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পাকি সেনা ভারতীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলীলে বিকেল চারটা ৩১ মিনিটে সই করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনী দালিলিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই দিন থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অনেক রক্ত, অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এই দিনটি বাঙ্গালী জাতির গৌরবের দিন, আনন্দের দিন, অহঙ্কারের দিন, আত্মমর্যাদার দিন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল অন্ধকারের শক্তি ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সবাই মিলে এই বিজয়লাভের পেছনে ছিল মূলত বাঙালির জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্বাধীনতার অর্থ ছিল মানুষের আত্মার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক মুক্তি অর্থাৎ আর্থিক উন্নতির পথ সুগম করা। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতাকে দেশবাসীর কাছে অর্থবহ করে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল একটি শোষণমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠা। স্বপ্ন ছিল এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা যেখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমরা সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের খুব বেশি সাফল্য দেখাতে পারিনি।
বাঙালী জাতির হাজার বছরের অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের সংবিধান। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন সংবিধানে অটল থাকা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ছাড়া বাঙালী জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনও সম্ভব নয়।
লেখক: লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চাইল্ড কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা-ঢাকা।
Posted ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin