অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান দখলদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আলবদর, আলশামস মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরাজয়ের আগ মুহূর্তে চরম প্রতিহিংসায় উন্মুত্ত পাকিস্তানি সেনাদের এদেশীয় দালালরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করে। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়। এ দুটি স্থান এখন বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষিত।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে। মেধাশূন্য করে বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতেই সেদিন সারা দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতেছিল হানাদার ও তাদের সহযোগীরা। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঠিক দুই দিন পর ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কৃতজ্ঞ জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি হানাদারদের জিঘাংসার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। বাঙালি জাতির জাগরণে বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ভূমিকার কারণে তাদের নিধন করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে।
বুদ্ধিজীবী হত্যায় মূলত ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তানি হানাদারদের এ দেশীয় বশংবদরা। আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর মনুষ্যবেশী পশুরা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা না দিলে, তাদের চিনিয়ে না দিলে তারা যে প্রাণ হারাতেন না তা এক বাস্তব সত্য।
একটি সদ্য স্বাধীন দেশের পথচলা, উন্নয়ন- অগ্রগতি ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মানে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী হতে পারে হন্তারকরা সেটা ভাল করেই জানত। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের পথচলাকে কঠিন করে তুলতেই জাতিকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক শূণ্যতার মধ্যে নিক্ষেপ করতেই সেদিন দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। বৃটিশ বিরোধী পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে যে সব বুদ্ধিজীবী সক্রিয় ও পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদেরই ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকান্ডের টার্গেট করা হয়। দেশবরেণ্য সে সব শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবীকে হারিয়ে জাতি সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত ও দিশাহারা হয়েছিল। সদ্যস্বাধীন দেশকে এগিয়ে নিতে তাদের জ্ঞান-গরিমা, অভিজ্ঞতা ও পথনির্দেশনা থেকে জাতি বঞ্চিত হয়েছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধারা একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই কাঙ্খিত গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষে এগিয়ে যেতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শিক্ষা, আদর্শ ও অনুপ্রেরণাকে সামনে রেখেই আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরসুরী নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক-সাংবাদিক, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজ সব ভেদাভেদ ভুলে এখন একটি জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পথরেখা অঙ্কন করবেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম।
Posted ৪:৪৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
dailymatrivumi.com | Mohammad Salahuddin